মনিরউদ্দিন নিচু গলায় বলে, উঠানের মইধ্যে দিমু। বাদলার সময় বড় প্যাককাদা হয়।
হইছে কি তোরক দেহি! ভূতে ধরছে, না জিনে ধরছে? ব্যাটা, তুই জমিদার হইছ?
বজলু সরকারের স্ত্রী বললেন, এরে বিয়া দেন : বিয়ার সময় হইলে মরদমাইনষে উল্টাপাল্টা কাম করে।
এরে বিয়া করব কে? পাগল-ছাগল!
বিয়ের ব্যাপারে তেমন কোন আগ্রহ দেখা যায় না। একেকটা বৰ্ষা যায়, নতুননতুন কিছু জিনিসপত্র আসে তার বাড়িতে।
তারপর এক সময় প্রায় জোর করেই বজল সরকার তার বিয়ে দিয়ে দেন। মেয়ে। পাশের গ্রাম কলমাকান্দার। হতদরিদ্র বাবা-মার ছ ছেলেমেয়ের সবচেয়ে বড় মেয়ে শরিফা। চোদ্দ বছরের রোগা একটি মেয়ে। সে স্বামীর সম্পত্তি দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়। কী সুন্দর টিনের ঘর। ঘরের ভেতর কাঁঠালকাঠের বিশাল সিন্দুক। সে ভয়ে-ভয়ে বলে, কী আছে সিন্দুকে?
মনির উদাস গলায় বলে, কিছু নাই। একদিনে কিছু হয় না। আস্তে আস্তে হয়। সিন্দুকটা ঝাড়পোছ কবি। ময়লা না-হয় যেন। খবরদার।
শরিফা বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ে। নতুন বৌকে মনিরের বড় ভালো লাগে। কিন্তু এই কথাটি বৌকে সে জানতে দিতে চায় না। জানলে লাই পেয়ে যাবে।
মেয়েজাতকে লাই দিতে নেই।
মনির বৌয়ের জন্যে শাড়ি কিনে আনে। অবহেলার সঙ্গে ফেলে রাখে সিন্দুকের উপর। হঠাৎ করে সেই শাড়ি পেয়ে শরিফার বিস্ময়ের সীমা থাকে না। ভয়ে-ভয়ে জিজ্ঞেস করে, শাড়ি কার?
মনিরউদ্দিন এমন ভাব করে যেন শুনতেই পায় নি। তারপর নিতান্ত বিরক্ত মুখ করে বলে, শাড়ি পিন্দনের মানুষ এই বাড়িত আর কেউ আছে?
শরিফা কল্পনাই করতে পারে না, তিনটি শাড়ি থাকা সত্ত্বেও কেউ আরেকটি শাড়ি কিনতে পারে। সে দীর্ঘ সময় নাকের সামনে শাড়িটা ধরে রাখে। নতুন শাড়িতে মাড়ের গন্ধটা তার বড় ভালো লাগে।
শুধু শাড়ি নয়, আরো সব জিনিসপত্র কাঠের সিন্দুকের উপর পড়ে থাকতে দেখা যায়। মিের কৌটা। এক শিশি গন্ধরাজ তেল। এক জোড়া স্পঞ্জের স্যান্ডেল। এত সৌভাগ্যে শরিফার ভয় করে। আবার বড় আনন্দও হয়। সব সময় ইচ্ছা করে স্বামীর জন্যে কিছু-একটা করতে। সেই সুযোগ বড়-একটা আসে না। মনিরকে ঘরেই পাওয়া যায় না। ভূতের মতো পরিশ্রম করে। সব সময় চিন্তা-কী করে বাড়তি দুটা পয়সা আসবে, মাটির ব্যাংক ভরে উঠবে-জমিজমা কিনবে। গোয়ালঘরে থাকবে নিজের গরু। গঞ্জে যাবে নিজের একটা নৌকায়। দিন কারোর একভাবে যায় না। আজ সে হতদরিদ্র। তার মানে এই নয় যে, সারা জীবন সে হতদরিদ্রই থাকবে। একদিন-না-একদিন সে দোনলা বন্দুক কিনবে। সেদিন খুব দূরে নয়।
গভীর রাতে মাঝে-মাঝে তার সে-সব স্বপ্নের কথা সে শরিফাকে বলে।
ও শরিফা।
কিতা?
পাকা দালান দিমু, বুঝছস? দোতলা দালান।
শরিফা কিছু বলে না।
দেখবি একদিন, লাখের বাতি জ্বলব আমার বাড়িত।
লাখের বাতি কী জিনিস?
শরিফার অজ্ঞতায় মনির হাসে, ভেঙে কিছু বলে না। লাখের বাতি হচ্ছে পুরোনো কালের এক উৎসব। কেউ লক্ষপতি হলে একটি উৎসব করা হয়। সেই উৎসবে লম্বা বাঁশের মাথায় বাতি জ্বালিয়ে রাখা হয়। দূর-দূরান্তের মানুষ সেই বাতি দেখে এবং বলাবলি করে লাখের বাতি জ্বলছে।
শরিফা।
কিতা?
লাখের বাতি জ্বলব ঘরে, দেখিস। জ্বললে কেমন হইব ক দেহি?
কিছু না-বুঝেই শরিফা বলল, ভালেই হইব।
শইলে আছে কাম করনের শক্তি। শইলের শক্তিটাই আসল।
মনির একটা হাত রাখে শরিফার দিকে। শরিফার বড় লজ্জা লাগে, আবার ভালো লাগে।
খবির হোসেন ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে
খবির হোসেন ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন।
ভিড়টা ছেলে-ছোকদের। একটি মানুষ সাপের কামড়ে মরতে বসেছে, অথচ বয়স্ক লোকজন কেউ নেই, এর কারণ কি? রহস্য কিছু-একটা নিশ্চয়ই আছে। জিজ্ঞেস করবার লোক নেই। জোহরের নামাজের সময় হয়ে যাচ্ছে। অজু করে আজান দিতে হবে। কিন্তু তাঁর উঠতে ইচ্ছা করছেন। এখানে যে-সব কাণ্ডকারখানা হচ্ছে সেসব দেখাও ঠিক হচ্ছে কি না তা বুঝতে পারছেন না। আল্লা-খোদর নাম নেওয়া হচ্ছে না, এটা কী ব্যাপার? একটা লোক ক্রমাগত হিন্দু দেব-দেবীর নাম বলে যাচ্ছে, এ কেমন কথা! ওঝাদের সাপের বিষ নামাতে তিনি আগেও দেখেছেন। সেখানে দেবদেবীদের নিয়ে এতটা বাড়াবাড়ি করা হয় না। ওঝারা নানান রকম ছড়াটড়া বলে।
এই ওঝা সেরকম নয়। খবির হোসেনের মনে হল, এর দম ফুরিয়ে আসছে। মন্ত্রতন্ত্র বেশিক্ষণ চালাতে পারবে না। গত আধা ঘন্টায় সে তিন বার পানি খেয়েছে এবং খানিকটা পানি নিজের মাথায় ঢেলেছে। এই মুহূর্তে সে ফতুয়ার পকেট থেকে একটি বিড়ি বের করে উদাস ভঙ্গিতে টানছে, যেন সে সমস্ত উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। এখন হাত-মুখ ধুয়ে বাড়ি চলে যেতে চায়। কিংবা চারটা ডাল-ভাত খেয়ে কাঁঠালগাছের নিচে আরাম করে বসতে চায়।
খবির হোসেন বললেন, ভাই, আপনার নাম কি?
নিবারণ শব্দ করে থুথু ফেলে বিরস মুখে বলল, নিবারণ। আমার নাম নিবারণ। দশ গায়ের লোকে আমারে চিনে।
নিবারণের কণ্ঠে স্পষ্ট বিরক্তি। সে অপমানিত বোধ করছে।
কি রকম দেখছেন?
কিছু বুঝছি না।
বিষ নামছে?
উঁহুঁ। তেজ বেশি। মঙ্গলবার কৃষ্ণপক্ষের রাইতে কারবার হইছে। মুশকিলটা বুঝছেন? বেজায় মুশকিল।
না, বুঝছি না। কী মুশকিল?
নিবারণ অত্যন্ত বিরক্ত হল। কড়া-কড়া কিছু কথা বলতে গিয়েও বলল না।
খবির হোসেন মনিরউদ্দিনের দিকে এগিয়ে গেলেন। তাঁর ইচ্ছা হচ্ছে তিন বার সুরা এখলাস পড়ে একটা ফুঁ দেবেন। আল্লাহ্র পাক কালাম হচ্ছে সবার উপরে।