বানিয়াবাড়ি এরকমই একটি গ্রাম তিনটি বিশাল হাওড় একে জড়িয়ে ধরে আছে। উত্তরে নাও ড়ুবির হাওড়। দক্ষিণে ও পশ্চিমে পাগলা হাওড়। পুবে মতিবিবির হাওড়।
মতিবিবির হাওড়ের পানি শীতেও পুরোপুরি শুকায় না। থকথকে কাদার উপর হাত তিনেক পানি থাকে। রাজ্যের দেশান্তরী পাখি উড়ে আসে। নাও ড়ুবির হাওড় এবং পাগলা হাওড়ের পানি শুকিয়ে যায়। চাষবাষ হয়।
বানিয়াবাড়ি খুব ছোট গ্রাম নয়। প্রায় সত্তরটির মত ঘর আছে। পাকা বাড়ি আছে দুটি। সবচেয়ে বড়টির বর্তমান ওয়ারিশান হচ্ছেন গোলাম আলি। তিনি ভাটি অঞ্চলে থাকেন না। উজান দেশে বাসাবাড়ি বানিয়েছেন। পানির উপর দিয়ে আসা ভেজা বাতাস তাঁর সহ্য হয় না। তিনি বছরে এক বার ভাগীদারদের কাছ থেকে ফসলের ভাগ নিতে আসেন, এবং যাবার সময় কিছু জমি বিক্রি করে যান। জমির উপর যাদের বেঁচে থাকা, তারা জমি বিক্রি কখনোই ভালো চোখে দেখে না। গোলাম আলির জন্যে কেউ বিন্দুমাত্র মমতা পোষণ করে না। বানিয়াবাড়িতে গোলাম আলির প্রসঙ্গ উঠলেই এরা বলে—গোলামের পুত গোলাম। গ্রামের দ্বিতীয় পাকা বাড়িটি বজলু সরকারের। লোকটি মহাকৃপণ। তাঁর তৃতীয় পক্ষের স্ত্রীর মরক্ষার জন্যে তিনি পাকা বাড়ি করেন বলে সবার ধারণা। ধারণা সম্ভবত সত্যি। বজলু সরকার পাকা বাড়ির মতো ব্যাপারে পয়সা খরচ করবার মানুষ নন। গ্রামের পাঁচ-ছ ঘর পরিবার অসম্ভব ধনী, যদিও তাদের বাড়িঘর বা জীবনযাপন পদ্ধতি দেখে তা আঁচ করবার কোনো উপায় নেই। গ্রামের বাদবাকি মানুষদের তেমন কোন জমিজমা নেই। এ নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথাও নেই। অন্যের জমি চাষ করে তাদের দিনকাল খারাপ যায় না। হয়তো ভাটি অঞ্চলের প্রকৃতিই এদের খানিকটা নিয়তিবাদী করে দিয়েছে। অনিত্য এই জগৎ-সংসারে ঘরবাড়ি দালানকোঠার তেমন কোনো প্রয়োজন নেই, এ-ধরনের বিষয়বস্তু নিয়ে রচিত গান এরা খুব আগ্রহ নিয়ে গায়।
মনিরউদ্দিন এর ব্যতিক্রম। তার মাথায় অল্প বয়সে একটা পোকা ঢুকে গেল। যেকরেই হোক নিজের একটা ঘর লাগবে। নিজের জমিজমা লাগবে। একটা নৌকা লাগবে। এখানেই শেষ নয়, বজলু সরকারের মতো একটি দোনলা বন্দুকও সে কিনবে।
এইসব স্বল্প সাধারণত দীর্ঘস্থায়ী হয় না। মনিরউদ্দিনের বেলায় কেমন করে হয়ে গেল। টাকা জমানোর নেশায় পেয়ে বসল। জোয়ান বয়স, বর্ষার সময় উজান দেশে গিয়ে কাঁচা পয়সা ওড়াবে, গঞ্জের মেয়েদের সঙ্গে রঙ্গ-তামাশা করবে তা নয়, বাঁশ কেটে কাঁচা টাকা জমায়। ঈদ উপলক্ষে নতুন লুঙ্গিগেঞ্জি কেনার টাকা দেন বজলু সরকার, সেই টাকাও ফেলে দেয় মাটির ব্যাংকে। এবং একদিন সত্যি-সত্যি মুখ কাঁচুমাচু করে বজলু সরকারকে জানায় সে একটা ঘর বাঁধতে চায়।
বজলু সরকার বিরক্ত হয়ে বলেন, ঘর দিয়া তুই করবি কি? বাংলাঘরে ঘুমাইতে কোনো অসুবিধা আছে? অত বড় ঘর পইড়া আছে।
নিজের একখান ঘর……।
নিজের ঘর দিয়া কী করবি? বিয়া-শাদি করনের মতলব নাকি?
মনিরউদ্দিন চুপ করে থাকে। বজলু সরকার দরাজ গলায় বলেন, সময় হইলে বিয়া আমিই দিমু। জমির অভাব নাই। একখান ঘর বানাইয়া থাকবি। গেল ফুরাইয়া। যা, কাম কর্ গিয়া।
একখান নিজের ঘর করতাম চাই।
নিজের ঘর, নিজের ঘর, বিষয় কি?
জমি কিন্যা ঘর বানাইতাম চাই।
তুই জমি কিনবি? পয়সা কই পাইবি?
জমাইছি।
কত জমাইছ? যা, নিয়া আয়।
টাকা তেমন কিছু না, কিন্তু এখানকার জমি সস্তা। ঘর বানানোর মতো জমি কেনা যায়।
বজলু সরকার গম্ভীর হয়ে বলেন, টাকা নষ্ট করনের দরকার দেখি না। ঘর। বানাইবার শখ হইছে, ঘর বানা। পুরান ভিটার কাছে আমার জমি পইড়া আছে। জংলা সাফ কইরা ঘর তোল।
টেকাডি রাইখ্যা দেন।
নিজের কামলার কাছে জমি বেচুম, পাইছস কি তুই আমারে? ঐটা তুরে দিলাম আমি, যা ভাগ।
একটা দলিল।
আরে ব্যাটা আমারে দলিল দেখায়……হইব,হইব। দলিলও হইব। যা যা, বিরক্ত করিস না।
দেখতে দেখতে মানকচু আর হেলেঞ্চার জঙ্গল কেটে চমৎকার একটা ঘর তুলে ফেলল মনিরউদ্দিন। বজলু সরকার সেই ঘর দেখে কেন জানি অস্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে গেলেন। লোকজনদের বলতে লাগলেন, পিরীতির গন্ধ পাই। হারামজাদা পিরীত করছে—অখন বিয়া করব। ঘর সাজায়। পাখনা উঠছে হারামজাদার।
পিরীতির ব্যাপারটা সত্যি নয়। তবে ঘর সাজানোর ব্যাপারে মনিরউদ্দিনের উৎসাহের সীমা নেই। গঞ্জে গেলেই এটাসেটা কিনে আনছে ঘরের জন্য। একবার কিনল একটা কাঠের চেয়ার। বিরাট ওজন সেই চেয়ারের। শীতের মরসুমে গঞ্জ থেকে সেই চেয়ার ঘাড়ে করে আনতে হল তাকেই। এগার মাইল রাস্তা—সোজা কথা নয়। পিঠের ব্যথায় কাজে যেতে পারে না। শুয়ে থাকতে হয় দু দিন।
বজলু সরকারের স্ত্রী রহস্য করে বলেন, কেমুন চিয়ার দেখন লাগে। হাতির মতো জোয়ানও কাবু হইছে। চিয়ারটা আমরারে দেখাইসরে মনির……।
গরিব মানুষের চিয়ার আম্মা।
তুই অখন আর গরিব কই? থানার দাবোগা আইলে অখন তোর বাড়িতে গিয়া উঠব। চিয়ার আছে, টেবিল আছে।
টেবিল নাই।
অখন নাই, দুই দিন পরে হইব।
টেবিল হয় না, তবে গ্রামের লোকজন অবাক হয়ে দেখে, মনির টিন কিনেছে। টিনের ঘর বাঁধবে। ব্যাপারটা কি, কেউ বুঝতে পারে না। বজলু সরকার বলেন, বেকুব মানুষ, কি করবা কও? দুই দিন পরে দেখবা ইট কিনছে, দালান দিব।
সত্যি-সত্যি এক বর্ষায় নৌকায় করে একগাদা ইট কিনে আনে মনিরউদ্দিন। বজলু সরকার চোখ কপালে তুলে বলেন, বিষয় কী?