গ্লাস ফেলে রেখে সে বেরিয়ে যায়।
ক্লাবে তার খাতির যেন কমে গিয়েছে। কি দরকার এদের সঙ্গে বসে পেগ টেনে!
তার চেয়ে নদীর ধারে গিয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য একটু উপভোগ করে আসা যাক।
সোজা এগিয়ে যায়। নদীর ধারে। একেবারে কিনারে।
জোয়ার-ভাটা যেখানে তলার মাটি খুঁড়ে ফোঁপরা করে দিয়েছিল।
এক চাপড়া ঘাস-গজানো মাটির সঙ্গে সে পড়ে যায় নদীর গর্ভে।
ভাগ্যে ঈশ্বর সেদিন তখনো খেয়া পারাপারের কারবার বন্ধ করে ঘরে ফিরে যায় নি। হরিণের কঁকের খবর পেয়ে ঈশ্বরের সাঙাৎ জাত শিকারি মোল্লা শেখ এবং তার চার-পাঁচজন সহশিকারি বলাই, মধু, মির্জা ইত্যাদি দুপুরে তার খেয়ায় দু পয়সা বেশি ভাড়া দিয়ে নদী পেরিয়ে চলে গিয়েছিল।
তারা ফেরে নি।
এমন কোনো আইন নেই যে, ওদের জন্য খেয়াঘাটে তাকে হাঁ করে বসে থাকতেই হবে।
স্টিমার এসে ভিড়েছে শেষ বেলায়–ছেড়ে যেতে সন্ধ্যা হচ্ছে।
সন্ধ্যার খানিক পরেই খেয়ানৌকা ঘাটের পাশে খুঁটিতে বেঁধে ঘরে গিয়ে সে খেয়েদেয়ে ঘুমোতে পারে।
কিন্তু মোল্লা শেখ বলে গিয়েছিল, ওপারে দু-তিনবার টর্চের আলো ঝলকে উঠতে দেখলে সে যেন নৌকা নিয়ে যায়।
ওরা বন থেকে কি শিকার করে আনে দেখবার কৌতূহল কম ছিল না ঈশ্বরের। তবু রাগে তার গা জ্বলছিল যে, সারাদিন খেটেও ঘরে গিয়ে দু-একটা রুটি বা ভাত খেয়ে শুয়ে পড়তে পারছে না।
খানিকটা ডাঙা নিয়ে নদীর গর্ভে আছড়ে পড়া অচৈতন্য প্রভাসকে বাঁচাবার জন্য ঈশ্বরকে নদীতে ঝাপ দিতে হয়।
হাঙ্গর কুমির তাদের দুজনকেই শেষ করে দেবে কিনা কে জানে!
কিন্তু চোখের সামনে মানুষটাকে এভাবে নদীতে আছড়ে পড়তে দেখলে চুপচাপ বসেও তো থাকা যায় না।
নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়।
প্রভাসকে তুলে আনে। তাকে খাতির করেই বোধহয় হাঙ্গর কুমিরেরা কোনো হাঙ্গামা করে না।
সোজা ঘাটে তুলতে পারে না। পাশে তুলে টেনেহিচড়ে ঘাটে নিয়ে আসে। দুজনেই জলে কাদায় ভিজে চুপসে একাকার হয়ে যায়।
কিন্তু তার খেয়াল ছিল, তার কিছু হোক বা না হোক প্রভাসের ঠাণ্ডা লাগবে।
খেয়াঘাটের জন্য খুদে একটা চালা।
জ্বালাতে হয় কেরোসিনের লণ্ঠন।
আজকাল আবার কেরোসিন পাওয়া যাচ্ছে না।
তাড়াতাড়ি প্রভাসকে কাদামাখা ভিজে কোর্ট প্যান্ট ছাড়িয়ে তার গায়ে জড়িয়ে দিয়েছিল নোংরা দুৰ্গন্ধ একটা কম্বল জেলখানায় কয়েদিরা শাস্তির প্রতীক হিসাবে যে কম্বল ব্যবহার করে।
কি করে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া যায় প্রভাসকে?
কি উপায় করবে ভেবে না পেয়ে পাঁচজন চেনা মানুষকে ডেকে আনতে যায়।
বুড়ো রামা কাশতে কাশতে বলে, সবাই মিলে থাবড়া কমিয়ে দে দিকি বোকা হাবাটার গালে। কান দুটো টেনে ছিঁড়ে থাবড়া মার। তাড়াতাড়ি থানায় খবর দেবে, একজন ডার ডাকাবে, সেটুকু বুদ্ধি মাথায় গজালো না বোকারামের।
বংশী বলে, নদী থেকে তুলে আনতে গেলি কেন বোকা হাঁদা? নদীতে ভেসে যেত–তোর কোনো দায় থাকত?
ঘনরাম সায় দিয়ে বলে, ঠিক কথা। নদীতে ভাসিয়ে দে চুকে যাক।
সাধু বলে, তোদের কি বুদ্ধি রে, বলিহারি যাই। থানায় যা, বাড়িতে খবর দে, ডার ডাক রাতদুপুরে যত ঝঞাট। এই তো কেলাব বাড়ি, আলো জ্বলছে দেখতে পাও না? গান বাজনা শুনতি পাও না? খানাপিনা হৈ-হুল্লোড় চলছে। হোথায় একটা খবর দিলে হাঙ্গামা চুকে যেত না কো?
তাই তো বটে, এই সহজ কথাটা এতক্ষণ কারো খেয়াল হয় নি? খবর দেবারই বা কি দরকার, তারাই তো ধরাধরি করে প্রভাসকে ক্লাবে পৌঁছে দিতে পারে।
ক্লাব তখন সরগরম। ওই অবস্থায় প্রভাস গিয়ে পৌঁছতে একটা হৈচৈ পড়ে যায়। ডাক্তার ক্লাবেই উপস্থিত ছিল, প্রাথমিক চিকিৎসা-ব্যবস্থায় বিলম্ব ঘটে না। সব বিবরণ শুনে কয়েকজন দুর্ঘটনার স্থানটি দেখতে চায়।
লঞ্চ নিয়ে আবার নাকি প্রভাস আর রবার্টসনের মধ্যে ফাটাফাটি হয়ে গিয়েছে। কার গুলিতে বাঘ মরেছে সেই ধরনের বিবাদ নয়। একেবারে নাকি ফাটাফাটি ব্যাপার।
কথা কাটাকাটি থেকে নেশার ঝোঁকে ঘুসোঘুসি পর্যন্ত গড়িয়ে থমকে থেমে থেকে, বাঘটা যে আসলে ঈশ্বরের গুলিতে মরেছিল এই সত্যটা টাকা দিয়ে কিনে মনের সাধে বিকৃত করতে গিয়ে বিশ্রী রকম জব্দ হয়ে আবার দুজনের ভাব হওয়ার মতো ব্যাপার নয়।
আসল স্বার্থঘটিত মারাত্মক ব্যাপার।
ভাব নেই, সিগার আর সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে হাসিগল্প করতে করতে দুজনে আর বেড়াতে বেরোয় না। কিন্তু দেখা হলে ভদ্রতা বজায় রাখে।
ক্লাবে এমনভাবে অন্য পাঁচজনের মতো পরস্পরের সঙ্গে মেলামেশা বজায় রেখেছে, দুজনে পৃথক হয়ে কখনো আর পেগ না টানলেও অন্য কয়েকজনের সঙ্গে এক টেবিলে বসে পেগ টানতে টানতে এমনভাবে কথাবার্তা চালিয়েছে, ব্রিজ কিংবা তিন তাসের জুয়া খেলার একই দলে ভাগ হয়ে পড়লে এমনভাবে সেটা মেনে নিয়েছে আর মিলেমিশে খেলে গিয়েছে যে, কেউ ভাবতেও পারে নি। সুযোগ পেলে এক মুহূর্ত ইতস্তত না করে একজন আরেকজনকে গুলি করে মেরে ফেলবে!
শুনে ঈশ্বরের হাসি পায় না। কে জানে কোথায় গড়াবে দুজনের এই প্রাণঘাতী বিবাদের পরিণাম, কতজনের সর্বনাশ হয়ে যাবে।
ঈশ্বর হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে গিয়েছে, গরিবকে না মেরে ওরা নিজেদের মারামারি টানতে পারে না।
ওদের মধ্যে যত বড় মারামারি, গরিবদের মধ্যে তত বেশি মরণ। নিজের প্রাণের মায়া না করে নদীতে ঝাপ দিয়ে প্রভাসকে ডাঙায় তুলে এনে বাঁচিয়েছে।
বনানী তাকে ডেকে পাঠায় না।
মিঠাই মণ্ডা খাইয়ে কৃতজ্ঞতা জানায় না।