সারাদিন গোপালের নিশ্চিন্ত প্রফুল্লভাব শশীকে পীড়া দিল। সে বুঝিতে পারিল গোপাল ধরিয়া লইয়াছে তাদের মধ্যে সমস্ত গোলমাল মিটিয়া গিয়াছে, দিনগুলি অতঃপর যেমন সহজভাবে কাটিতেছিল তেমনিভাবে কাটিতে থাকিবে। এমন একটা জটিল ব্যাপারের এত সহজে এরকম মনোমতো পরিণতি ঘটিবে, গোপালকে ইহা বিশ্বাস করিতে দেখিয়া আশ্চর্যও শশী কম হইল না। তার কাছে কী প্রত্যাশা করে গোপাল? এমন আকুল আগ্রহে কেন সে তাকে ধরিয়া রাখতে চায়? মতে তাদের কখনও মিল হইবে না, প্রতিদিন খিটিমিটি বাঁধিবে, স্নেহ মমতা শ্রদ্ধা ভক্তি পাহাড়কে চাপা দিয়া স্তুপাকার হইয়া উঠিবে অশান্তির হিমালয়। তবু শশীকে গ্রামে বসিয়া এই আত্মবিরোধময় সংকীর্ণ জীবন যাপন করিতে হইবে? এতবড় বিপুল পৃথিবী পড়িয়া থাকিতে তাদের দুটি বিরোধী ব্যক্তিত্বকে অর্থহীন অব্যবহার্য মেহের মোহ আশ্রয় করিয়া থাকিতে হইবে এ ক্ষুদ্র গৃহকোণে?
সেনদিদির ছেলেকে বাড়িতে আনার জন্য মনে মনে শশীর যত বড়ো আঘাতই লাগিয়া থাক, গৃহত্যাগের কারণ হিসাবে আজ তা বহুগুণে তুচ্ছ হইয়া গিয়াছে। গ্রাম ছাড়িয়া যাইতে যে গভীর দুঃখ জাগিয়াছে শশীর মধ্যে, ও-ধরনের মানসিক বিতৃষ্ণার অজুহাত তার কাছে খাটানো চলে না; আরও বড় লোভ, আর বড় আকর্ষণ দরকার হয়। অথচ গোপালের পক্ষে তা ধারণা করাও অসম্ভব। শশী চলিয়া গেলে তার যাওয়ার ঐ একটি কারণের কথাই গোপাল জানিয়া রাখিবে—সেনদিদির ছেলেকে বাড়ি আনা।
শীতলবাবু ডাকিয়াছিলেন। অমূল্যর সঙ্গে সন্ধ্যার পর শশী তার বাড়ি গিয়াছিল। অমূল্যকে জলটল খাওয়াইয়া শীতলবাবু সকাল সকাল ছাড়িয়া দিলেন, শশকে ছাড়িলেন রাত্রির আহারের পর, অনেক রাত্রে। শীতলবাবু আর এক বিপদ হইয়াছে শশীর, দুবেলা ডাকেন আর গেলেই কথায় কথায় পাগল করিয়া তোলেন শশীকে। বাড়ি ফিরিয়া শশী দেখিল আহারের স্থানে পাশাপাশি দুখানা আসন পাতা আছে এবং যে গোপাল আটটায় খাইতে বসে সে আজ তার প্রতীক্ষায় এগারোটা পর্যন্ত না-খাইয়া বসিয়া আছে।
এত দেরি করলে যে শশী? চট করে মুখহাত ধুয়ে এসো, বসে পড়ি আমরা।
শশী বলিল, আপনি বসুন, আমি খেয়ে এসেছি। শীতলবাবু না-খাইয়ে ছাড়লেন না।
গোপাল ক্ষুন্ন হইয়া বলিল, আজ রান্নার একটু আয়োজন করতে বলেছিলাম বাবা, ভাবলাম পরের ছেলে একটি বাড়িতে এসে আছে, আজবাদে কাল চলে যাবে, একদিন একটু আয়োজন-পত্ৰ করি খাওয়ার। তুমি খেয়ে আসবে বাইরে থেকে, তা জানতাম না।
শশী জিজ্ঞাসা করিল, পরের ছেলে কে?
গোপাল বলিল, অমূল্যবাবুর কথা বলছি। আহা, ডেকেডুকে এনে চলে যেতে বললে বড় লাগবে বেচারির মনে।
শশী বলিল, অমূল চলে যাবে কেন? ওকেই তো হাসপাতালে কাজ দেওয়া হয়েছে?
গোপাল সভয়ে বলিল, তুই থাকলে ও আবার কী করতে থাকবে শশী, অ্যাঁ?
আমি পরশু রওনা হব ভাবছি।–শশী বলিল।
পরশু? গোপালের মুখে আর কথা ফুটিল না। শশী ঘরে চলিয়া গেলে সে একেবারে বাহিরের দাওয়ায় গিয়া অন্ধকারে কাঠের বেঞ্চিটাতে বসিয়া রহিল। একজন মুনীষ দাওয়ায় শয়নের আয়োজন করিতেছিল, সে এক ছিলুম তামাক সাজিয়া দিল গোপালকে, তারপর মনিবের সামনে শুইয়া পড়িতে না পারিয়া বিছানো চাটাইটির উপর উবু হইয়া বসিয়া শ্রান্তিবশত জোরে একটা নিশ্বাস ফেলিল। আজ আবার ব্রহ্মচারীকে মনে পড়িতেছে গোপালের, সেনদিদির মৃত্যুর পর মনে যে গভীর বিষাদ ও বৈরাগ্য আসিয়াছিল, ব্রহ্মচারীর মুখে নীরস আধ্যাত্মিক কাহিনী শুনিতে শুনিতে এক আশ্চর্য উপায়ে তার ঘোরটা কাটিয়া গিয়াছিল। আজ বড় অবসন্ন মনে হইতেছে নিজেকে। বিচিত্ৰ কাণ্ডকারখানা ভরা দীর্ঘ জীবনটা আজ অকারণ, অর্থহীন মনে হইতেছে-কোনো কাজেই লাগিল না! শশীর জন্মের দিনটি হইতে তারি পানে চোখ রাখিয়া কত কল্পনাই গোপাল করিয়াছে—যার ডগাটি আকাশে ঠেকিয়া প্রায় হইয়াছে আকাশ-কুসুম খেলখাপড়া শিখিয়া এ কী রীতিনীতি শিখিয়াছে শশী? বাগান, বাড়ি, জমিজমা, ধনসম্পদ, আত্মীয়পরিজন-এত সব যে গোপাল একত্র করিয়াছে, এ কী তার নিজের জন্য? তার আর কতদিন বাকি। এসব তুচ্ছ করিয়া শশী যদি চলিয়া যায়, সমস্ত জীবনটাই গোপালের ব্যর্থ হইয়া যাইবে না?
এত রাত্রে সে একবার অমূল্যের ঘরে যায়। অমূল্যকে জাগাইয়া বলে, একটা কথা শুধোই বাবু তোমাকে। শশী পরশু চলে যাবে আমায় যে বলনি?
রাতদুপুরে ঘুমন্ত মানুষকে তুলিয়া গোপালের এই কৈফিয়ত দাবি করা অমূল্যকে ভড়কাইয়া দেয়। সে বলে, আমি জানতাম না, কবে যাবে শশী, আমায় কিছু বলেনি।
গোপাল অসন্তোষের সুরে বলে, আর সব বললে, একথাটা বললে না? কী যেন মতলব ছিল বাবু তোমার, তাই গোপন করেছিলে।
অমূল্য জিভ কাটিয়া বলে, আজ্ঞে না, সে কী কথা!
গোপাল বলিল, সে কী কথা! আমার ছেলে দেশছাড়া হবে চিরকালের জন্যে আর তুমি তার জায়গায় জেকে বসবে, বড় ভালো মতলব তোমার! ওঠো দিকি বাবু সুখশয্যা ছেড়ে, জিনিসপত্র চুপিচুপি গুছিয়ে নাও তারপর চলো আমরা বিদেয় হই।
ডাতাকের মতো দেখায় গোপালকে, খুনে দাঙ্গাবাজের মতো শোনায় কথাবার্তা। অমূল্যের ঘরে যে বিচিত্র, নাটকীয় কথোপকথন চলে, কিছুই শান্ত শশীর চেতনায় পৌঁছায় না; জীবন সম্বন্ধে যে অমন তীব্রভাবে সচেতন, সে হইয়া থাকে পুতুলের মতো চেতনাহীন। তাকেই বাৎসল্য করে বলিয়া মধ্যরাত্রে গোপাল আজ যে বিচিত্র দৃশ্যের অবতারণা করে, যেসব অদ্ভুত কথা বলে, তা দেখিলে ও শুনিলে একটা অভিজ্ঞতা জন্মিয়া যাইত শশীর। চাপা গলায় খানিকক্ষণ অমূল্যের প্রতি তর্জনগর্জন করিয়া গরম মাথাটা বোধ হয় একটু ঠাণ্ডা হয় গোপালের, সে ঘরে যায়।