ঝড় উঠিল সম্পূর্ণ অন্য দিক দিয়া। হঠাৎ সেনদিদির ছেলেকে কোলে করিয়া কোথা হইতে কুন্দ আসিয়া দাঁড়াইল। বলিল, খেয়ে উঠে একবার দেখবেন তো শশীদাদা, গাটা বড় গরম বোধ হচ্ছে।
শশী মুখ তুলিল না, কথা বলিল না। গোপাল বা হাত বাড়াইয়া উদ্বিগ্নকণ্ঠে বলিল, জ্বর হয়েছে নাকি? দেখি। দ্যাখ তো শশী একবার হাত দিয়ে? জ্বর মনে হচ্ছে যেন।
শশী নিঃশব্দে ভাত ফেলিয়া চলিয়া গেল।
জ্বর হয়েছে কি না দেখিবার জন্য অতটুকু শিশুর গায়ে একবার হাত দিবার অনুরোধ। তার জবাবে অমন করিয়া উঠিয়া গেলে সে কাজের মানে গোপালের মাথাতেও ঢোকে বৈ-কি। কুন্দর বিস্মিত দৃষ্টিপাতে লজ্জায় গোপালের গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। অভ্যস্ত গলায় হুংকার দিয়া কুন্দকে বলে, দূর হ, সামনে থেকে দূর হ হারামজাদী।
বিনা দোষে এমন গর্জন কুন্দ সহিতে পারে না, প্রথমে সে বিহাল হইয়া গেল, তারপর কাঁদিতে কাঁদিতে চলিয়া গেল নিজের ঘরে। দেখিতে দেখিতে বাড়ির কৌতুহলী মেয়েরা সেখানে গিয়া হাজির। কিছুদিন হইতে এ-বাড়ির কাণ্ডকারখানায় সকলে ভ্যাবাঁচাকা খাইয়া যাইতেছে। সাহসী কুন্দই সম্প্রতি ও আশ্চর্য হইয়া গেল।
কেন রে কুন্দ, বকল কেন রে তোকে?
কুন্দ কি সহজে সে কথা ফাঁস করে? ফাঁসফোঁস করিয়া সকলকে সে চলিয়া যাইতে বলে, কেন বিরক্ত করছ আমায়? অনেক তোষামোদে একটু ঠাণ্ডা হয় কুন্দ, তারপর গোপালের রাগের কারণটা ব্যক্ত করে। বলে, আমার যেমন পোড়া কপাল! সেনদিদিও ছেলেটাকে শশীদার সামনে নিয়ে যেতে কতবার মামা বারণ করেছে, তা কথাটা একদম ভুলেই গেলাম। সাদাসিধে মানুষ বাবু আমি, ওসব ঘোরপ্যাচের কথা কি ছাই আমার মনে থাকে!
সকলে বলে, হ্যাঁ লো কুন্দ, ও ছেলেকে আনার পর থেকে বুঝি শশী এমন রেগে আছে, বাপের সঙ্গে কথা কয় না, বিবাগী হয়ে বেরিয়ে যাবে বলে?
নয়তো কী? কুন্দ বলে।
একটু হাসে কুন্দ কে জানিত তলে তলে এমন বাকা মন আমাদের ঠোট কাটা কুন্দর বলে, এই ছেলেটাকে নিয়ে বাপ-বেটার কত কী চলেছে তোমরা কী জানবে টের পাই আমি। কী হয় দেখবার জন্যেই তো দুজনে একত্তর খেতে বসেছে দেখে ছেলেটাকে নিয়ে গেলাম। অমন গাল খাব তা ভাবিনি ছোটমামি। আর এখনি হয়েছে কী, একে নিয়ে কী ভীষণ কাণ্ড হয় দেখো, যেমন-তেমন মায়ের ছেলে তো নয় এ।
তার ওপরে মাই খাচ্ছে তোর, না রে কুন্দ? ও ছেলে দেবেই তো ঘরে আগুন!
জ্বর বোধ হয় একটু হইয়াছিল ছেলেটার, গোলাপি বর্ণ তাহার আরও লালিম হইয়া উঠিয়াছে, তাকাইলে চোখ ফেরানো যায় না এমন আশ্চর্য সুন্দর শিশু, তাকে কেন্দ্র করিয়া এক বাড়িতে এতবড় একটা ঝড় উঠিবার উপক্রম হইয়াছে এ যেন বিশ্বাস করা যায় না। কুন্দর চারিদিকে সমবেত মায়েরা দুর্ভাগা ছেলেটাকে ঈর্ষা করে, বাৎসল্য ব্যাকুলও হয়। এর সঙ্গে এক বাড়িতে বাস করিতে চাহে না, কী কঠোর মনটা শশীর, মেহলেশশূন্য অন্তঃকরণ।
সেদিন রাত্রে বিনিদ্র গোপাল কী সব ভাবিল সে-ই জানে, পরদিন সকালে কুন্দকে সে চালান করিয়া দিল তার খুড়-শ্বশুরের বাড়ি রাজাতলায়, সঙ্গে গেল তার স্বামীপুত্র এবং সেনদিদির ছেলে।
কাজটা করিয়া গোপাল যেন অনেকটা নিশ্চিত হইল। রাগের কারণ দূর হইল, আর তো শশীর রাগ থাকিবে না। সেনদিদির ছেলে পৃথিবীতে আসিয়াছে বলিয়া শশী রাগ করে নাই, তাকে বাড়িতে আনা হইয়াছে বলিয়া সে গৃহত্যাগ করিয়া যাইতেছে। এ অন্যায় আবদার শশীর অসঙ্গত ব্যবহার, তবু মাথা নিচু করিয়া গোপাল যখন তাহার অভিযোগের প্রতিকার করিল, বাড়ি ছাড়িয়া যাইতে কি আর শশী পরিবে!
পরের মুখে খবরটা ঠিকমতো শশীর কানে পৌঁছেবে না আশঙ্কা করিয়া চোখ-কান বুজিয়া নিজেই গোপাল তাহাকে শোনাইয়া দিল। বলিল, কুন্দকে আজ শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দিলাম শশী।
শশী বলিল, রাজাতলায়?
গোপাল বলিল, হ্যাঁ। যামিনীর ছেলেটাকেও ওর সঙ্গে দিয়ে দিলাম।
যামিনীর ছেলে প্রসঙ্গ উঠিলে শশী মুখ খোলে না। গোপাল আবার বলিল, কুন্দ এখন ওখানেই থাকবে বলে দিয়েছি এখানে আসবার ওদের কোনো দরকার নেই।
শশীর সঙ্গে ষড়যন্ত্র করিয়াই কাজটা সে যে হাসিল করিয়াছে এমনিভাবে গলা নামাইয়া গোপাল জাবাব বলিল, আসল কথা কী জানিস বাবা, এক ঢিলে দুটো পাখি মেরেছি। কুন্দকেও সরালাম, পরের ছেলে ঘাড়ে করার দায় থেকেও রেহাই পেলাম। যা খুশি করুক গিয়ে এবার, আমি কিছু জানি না–কেঁদেকেটে চিঠি লেখে দু-চার টাকা পাঠিয়ে দেব, বাস্, ফুরিয়ে গেল সম্পর্ক।
তাই যদি ইচ্ছা ছিল গোপালের, বিপিনের কাছ হইতে সেনদিদির ছেলের ভার গ্রহণ করিবার তার কী প্রয়োজন ছিল শশী তা জানিতে চায় নাই তাই রক্ষা, জবাব গোপাল দিতে পারিত না। শশীকে গোপাল ছাড়িতে পারে না, সেনদিদির ছেলেকে ফেলিতে পারে না, অনেক ভাবিয়া চারিদিক রক্ষা করার জন্য পাকা রাজনীতিকের মতো সে যে চাল চালিয়াছে তার সমর্থনের জন্য এরকম দুটো-একটা বানানো পাকা কথা না বলিলে চলিবে কেন ছেলের সঙ্গে তর্ক করিয়া অখণ্ড যুক্তি দাঁড় করানোর জন্য তো এসব বলা নয়, এ শুধু তাকে জানানো যে হার গোপাল মানিয়াছে, ওরে পাথরের পুত্র-দেবতা, এবার তুই তোর ভীষ্মের প্রতিজ্ঞ ছাড়।
সেনদিদির ছেলেকে সরাইয়া নেওয়ার জন্য শুধু নয়, তাকে ধরিয়া রাখার জন্য গোপালকে এমন উতলা হইয়া উঠিতে দেখিলে হয়তো শশী মত বদলাইয়া ফেলিত, আবার হয়তো বাতিল হইয়া যাইত তাহার গ্রামত্যাগের কল্পনা। এখন বড় দেরি হইয়া গিয়াছে। মন তো শশীর কখন চলিয়া গিয়াছে দূরতর দেশে নবতর জীবনযাপনে, এখন শুধু বেঁচেকা ঘাড়ে সেখানে পৌছনো বাকি-তাও দুচারদিনের মধ্যেই ঘটিবে।