সঙ্গে করিয়া অমূল্যকে সে হাসপাতালে লইয়া গেল, নিজের চেয়ারের পাশে তার জন্য চেয়ার পাতিয়া দিল। একটু মোটাসোটা মানুষ অমূল্য, ধীর শান্ত প্রকৃতি, কিন্তু উৎসাহের অভাব নাই। নিবিড় মনোযোগের সঙ্গে সে শশীর কাজ
নিয়মকানুনের বিষয়ে প্রশ্ন করিল। মনে হইল, এখন হইতেই সে যেন গভীর দায়িত্ব বোধ করিতেছে। শশী চলিয়া যাইবে, আর কখনও ফিরিয়া আসিবে না, একথা শুনিবার পর এখানকার সমগ্র নূতনত্বের অন্ধকারে তার নিজের আলোটি জ্বলিবার অধিকার যেন তার জনিয়াছে। একটু সমালোচনাও অমূল্য করিল। এই নিয়মটা এমন হইলে ভালো হইত না শশী, এই ব্যবস্থার বদলে এই ব্যবস্থা? এসব সুলক্ষণ, কাজকর্ম অমূল্য যে ভালোই করিবে তার প্রমাণ, তবু মনে মনে শশীর অকারণে ক্ষোভ জাগিতে লাগিল। তার একটা রাজ্য যেন কে বেদখল করিতে আসিয়াছে—কত যত্নে কত পরিশ্রমে শশী যে গড়িয়া তুলিয়াছে তার এই হাসপাতাল, লোকে যে এটা শশী ডাক্তারের হাসপাতাল বলিয়া জানে! ফোড়াকাটা ক-খানা ছুরি আছে হাসপাতালে তাও শশীর গোনাগাথা। গ্রাম ছাড়িয়া চলিয়া যাইবে জানিয়াও ধীরে ধীরে হাসপাতালটিকে বড় করিয়া তুলিবার কল্পনা সে তো কম করে নাই। দুদিন পরে এখানে কর্তৃত্ব করিবে অমূল্য, হয়তো উন্নতি হইবে, হয়তো অবনতি হইবে, কিছুই শশী দেখিতে আসিবে না।
যাওয়ার কথা ভাবিতে ভাবিতে এমন হইয়াছিল শশী যে সে যেন ভুলিয়া গিয়াছিল কেহ তাহাকে যাইতে বলে নাই, নিজে সে সাধ করিয়া যাইতেছে, এখনও যাওয়া বন্ধ করিলে কেহ তাহাকে কিছু বলিতে আসিবে না। না গেলে তার যে চলিবে না, যাইতে সে যেন বাধ্য। কে যেন গা হইতে তাহাকে তাড়াইয়া দিতেছে, থাকিবার উপায় নাই।
যাইতে ক্ষোভই বা কিসের শশীর? কতকাল ধরিয়া কতভাবে সে যে তার যাওয়ার কামনাকে পুষ্ট করিয়াছে? যাওয়ার আয়োজন শুরু করিবার সময় দ্বিধা না করিবার, গাফিলতি না করিবার প্রতিজ্ঞাই বা কোথায় গেল শশীর? অমূল্যের মধ্যে নিজের ভবিষ্যৎ প্রতিনিধিকে দেখিয়াই মনটা এমন বিগড়াইয়া গেল? জীবনের বিপুল ব্যাপক বিস্তারের স্বপ্ন দেখিয়া যার দিন কাটিত, এই তুচ্ছ গাওদিয়া গ্রামে এই ক্ষুদ্র হাসপাতালের মোহে আবদ্ধ হইয়া থাকিতে চাওয়ার কথা তো তার নয়!
অমূল্যকে দেখিয়া এবং সে কেন আসিয়াছে শুনিয়া গোপাল আরও ভড়কাইয়া গেল। আর সে চুপ করিয়া থাকিতে পারিল না। রাত্রে শশী খাইতে বসিলে কোথা হইতে আসিয়া নীরবে একখানা আসন আনিয়া নিজেই পাতিয়া গোপাল তার পাশে বসিল। পিসি ছুটিয়া জলের গ্লাস দিয়া অদূরে বসিতে যাইতেছিল, গোপাল বলিল, যা তুই ক্ষান্ত, পাকঘরে বসবি যা।
পিসি চলিয়া গেলে গোপাল বলিল, তুমি কোথায় যাবে শশী?
শশী বলিল, প্রথমে আপাতত কলকাতায় যাব।
গোপাল বলিল, তারপর পশ্চিম-টশ্চিম একটু ঘুরে বেড়িয়ে বাড়ি ফিরবে বুঝি? মাসখানেক লাগেব তোমার, না?
কলকাতা থেকে বিলেত যাব।
বিলেত? মুখে একগ্রাস ভাত তুলিয়াছিল গোপাল, সেটা গিলিতে গিয়ে দম যেন আটকাইয়া আসিল।–বিলেত কেন?
শিখে টিখে আসব।–শশী বলিল।
গোপাল ব্যাকুলভাবে বলিল, তাতে তো অনেকদিন লাগবে শশী। দু-তিন বছরের কম নয়। এতকাল আমি একা পড়ে থাকব গাঁয়ে?
শশী আশ্চর্য হইয়া বলিল, একা পড়ে থাকবেন?
না, একা নয়, ঘরভরা আত্মীয়-পরিজন থাকিবে গোপালের, গ্রামভরা থাকিবে শক্রমিত্র। তবু শশী না থাকিলে কী একাই যে সে হইয়া যাইবে এতবড় ছেলেকে কেমন করিয়া গোপাল আজ তা বোঝায়। এ জগতে আর কে আছে একা গোপালের অন্তর জুড়িয়া? হৃদয় তাহার কী রীতি পালন করিয়াছে গোপাল তা জানে মা, এ জগতে একটা মানুষকে সে স্নেহ করিতে পারে নাই, নিজের মেয়ে কটাকে পর্যন্ত নয়; শুধু শশীর জন্য, একা শশীর জন্য, উন্মাদ বাৎসল্য আজও বুক জুড়িয়া আছে। গাম্ভীর্য, ধীরতা সব খসিয়া যায় গোপালের, জড়ানো ভারী গলায় সে বলে ; কেন যাবি বাবা, আমার ওপর রাগ করে, তোর তো আমি কিছুই করিনি!
শশী মৃদুস্বরে বলিল, জীবনের উন্নতি করতে যাব, এতে রাগের কী আছে?
একটু ভাবিয়া গোপাল বলিল, তিন-চার বছর পরে ফিরে এসে হয়তো আমায় আর দেখতেই পাবি না শশী।
তিন-চার বছর পরেও সে যে ফিরিয়া আসিবে না সে-বিষয়ে শশী কিছু বলিল না। নীরবে ভাত মাখিতে লাগিল।
গোপাল আবার বলিল, বুড়ো হলাম, হঠাৎ একদিন যদি মরে যাই, তুইও কাছে না থাকিস, কে এসব দেখবে শশী? সারাজীবন খেটেখুটে যা-কিছু করেছি সব যে ছারেখারে যাবে।
শশী বলিল, আপনার যাকে খুশি সব দিয়ে দেবেন।
এ তো ছেলেমানুষ কথা হল শশী, রাগের কথা হল! বলিয়া গোপাল উৎসুক দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল। মিথ্যা আশা। প্রতিবাদ করিয়া কিছুই তো শশী বলিল না। ভিতরে ভিতরে একটা জ্বালা বোধ করিতেছিল গোপাল, কী অদ্ভুত বিকারগ্রস্ত সে সস্তান, যার মনের নাগাল মেলে না? কী হইয়াছে বলুক না শশী, জানাক না ঠিক কী সে চায়। অনেক অধিকার ত্যাগ করিয়া ছেলের ইচ্ছায় গোপাল আজ সায় দিবে। নিজের অনিচ্ছার দিকে একেবারেই তাকাইবে না। উপযুক্ত হইয়াছে অবাধ্য হইয়াছে ছেলে, কী আর করিবে গোপাল, নীরবে সবই তাহাকে সহিতে হইবে! এই ধরনের কথা কিছু শশীকে সে বলে। তার কথায় একপ্রকার অদ্ভুত মিনতি ধ্বনিত হইতে থাকে। কী উগ্র ক্রোধ আর নিদারুণ ভয় আর গভীর দুঃখ মনের মধ্যে চাপিয়া রাখিয়া গোপাল কথা বলিতেছে বুঝিতে পারিয়া নিজেকে বড় বিপন্ন বোধ করে শশী, তবু ধরাছোয়া সে দেয় না। পিতাপুত্রে কী আজ শুরু হইয়াছে বুঝিতে কাহারো বাকি থাকে নাই, ঘরে ঘরে দরজাজানালার আড়ালে জড়ো হইয়া সকলে ওঁত পাতিয়া আছে, চড়া গলায় এদের কথা শুরু হইলে প্রাণ ভরিয়া শুনিবে। বাড়ির একটা অস্বাভাবিক স্তব্ধ আবহাওয়া স্পষ্ট অনুভব করা যায়। কখন ঝড় উঠবে ঠিক নাই।