পরদিন সকালে হাসপাতাল-কমিটির মেম্বারদের কাছে শশী জরুরি চিঠি পাঠাইয়া দিল। শীতলবাবুর বাড়িতে সন্ধ্যার পর কমিটির জরুরি সভা বসিল। শশী পদত্যাগপত্র পেশ করিল, ডাক্তারের জন্য বিজ্ঞাপনের খসড়া দাখিল করিল, প্রস্তাব করিল যে হাসপাতালের সমস্ত দায়িত্ব কমিটির সুযোগ্য প্রেসিডেন্ট শীতলবাবুর হাতে চলিয়া যাক।
কমিটির হতভম্ব সভ্যেরা প্রশ্ন করিলেন, কেন শশী, কেন?
শশী বলিল, আমি গাঁ ছেড়ে চলে যাচ্ছি।
এবার আর দ্বিধা নয়, গাফিলতি নয়। অনিবার্য গতিতে শশীর চলিয়া যাওয়ার আয়োজন অগ্রসর হইতে থাকে। হাসপাতাল-সংক্রান্ত ব্যাপারগুলি শীতলবাবুকে বিশদভাবে বুঝাইয়া দেয়, টাকাপয়সার সম্পূর্ণ হিসাব দাখিল করে, আর ভবিষ্যতের কার্যপদ্ধতি সম্বন্ধে কিছু কিছু নির্দেশও লিখিয়া দেয়। ডাক্তারের জন্য কাগজে যে বিজ্ঞাপন দেওয়া হইয়াছিল তার জবাবে দরখাস্ত আসে অনেকগুলি। কমিটির সভ্যদের সঙ্গে পরামর্শ করিয়া তাদের মধ্যে কয়েকজনকে শশী দেখা করিতে আসিবার জন্য পত্র লিখিয়া দেয়।
সকলে খুতখুঁত করে, কেহ কেহ হায় হায় করিতেও ছাড়ে না। কোথায় যাইবে শশী, কেন যাইবে? সে চলিয়া গেলে কী উপায় হইবে গায়ের লোকের? পাস-করা ডাক্তারের দরকার হইলে আবার কি তাহদের ছুটিতে হইবে বাজিতপুরে? সকলে কৈফিয়ত চায় শশীর কাছে, তার সঙ্গে তর্ক জুড়িবার চেষ্টা করে। শশী না দেয় কৈফিয়ত, না করে তর্ক। মৃদু একটু হাসির দ্বারা অন্তরঙ্গতাকে গ্রহণ করিয়া প্রশ্নকে বাতিল করিয়া দেয়।
তবু খবরটা প্রচারিত হওয়ার পর হইতে চারিদিক এমন একটা হৈচৈ শুরু হইয়াছে যে মনে মনে শশী বিচলিত হইয়া থাকে। কেবল ডাক্তার বলিয়া স্বার্থের খাতির তো নয়, মানুষ হিসাবেও মনের মধ্যে সকলে তাহাকে একটু স্থান দিয়াছে বৈ-কি। সাধারণের ব্যাপারগুলিতে সে উপস্থিত থাকিলে সকলের মনে উৎসাহের সঞ্চার হয়, তার উপরে নির্ভর রাখিয়া সকলে নিশ্চিন্ত থাকে। এ তো অকারণে হয় না, কতবড় সৌভাগ্য শশীর, না চাহিয়া জনতার এই প্রীতি পাইয়াছে। এ তো শুধু সৎকার্যের পুরস্কার নয়। কী এমন সৎকাজটা শশী করিয়াছে? রাস্তাঘাটের সংস্কারের জন্য কোদাল ধরে নাই, ম্যালেরিয়া নিবারণের ছাত্রসঙ্গ প্রভৃতি গড়িয়া তোলে নাই, কিছুই করে নাই। শুধু হয়তো আশেপাশে দশটা গ্রামে শশীর চেয়ে বেশি প্রভাব আর কাহারো নাই! শশীকে যদি সকলে ভালো না বাসিবে এমনটা তবে হইবে কেন?
শশী তাদের ভালোবাসে, শশীকে তারা ভালোবাসিয়াছে? গ্রাম ও গ্রাম্যজীবনের প্রতি মাঝে মাঝে শশী গভীর বিতৃষ্ণ বোধ করিয়াছে, ধরিতে গেলে আজ কত বছর এখানে তার মন টিকিতেছে না; তবু ক্ষতের বেদনার মতো স্থায়ী একটা কষ্ট শশীর মধ্যে আসিয়াছে, গ্রাম ছাড়িবার কথা ভাবিলে কেমন করিয়া উঠে মনটা। এখানে জন্ম শশীর, এখানেই সে বড় হইয়াছে। এই গ্রামের সঙ্গে জড়ানো তার জীবন। কুসুম ছিল বিদেশিনী, যেদিন শখ জাগিল নির্বিকার চিত্তে বিদায় হইয়া গেল-শশী কেন তা পরিবে? রওনা হওয়ার সময় চোখের কোণে জল পর্যন্ত আসিবে শশীর। নিশ্চয় আসিবে।
কুন্দ কাঁদে –কেন শশীদা, কেন চলে যাচ্ছেন আমাদের ছেড়ে?
সেনদিদির ছেলের ভার লওয়ায় কুন্দর কাজ বাড়িয়াছে, তবু সে শশীর সেবা বাড়াইয়া দেয়। শশী যতক্ষণ বাড়িতে থাকে কোনো-না-কোনো ছলে কুন্দ বারবার কাসে আসে, ছলছল চোখে শশীর দিকে তাকায়, কত কী বলিতে চায় কুন্দ, সব কথা বলিতে সাহস পায় না।
কি রে কুন্দ, কী হল তোর? কুন্দ বলে।
কুন্দ বলে, আপনার জন সবাইকে ফেলে চলে যাওয়া কি ভালো শশীদাদা?
কেউ কি তা যায় না কুন্দ? সকলে কি দেশে গাঁয়ে থাকে?
যারা যায় পেটের ধান্দায় যায়, আপনার যাবার দরকার?
কার মেহের অভাবে এমন হু হু করিতেছে শশীর মন যে কুন্দর একটুকু মমতায় তার মোহ জাগে? মনে হয় আরও একটু মায়া করুক কুন্দ, আরও একটু কাতর হোক।
কাতর হইয়াছে গোপাল। একেবারে যেন আধমরা হইয়া গিয়াছে মানুষটা। নিজের বাড়িতে চোরের মতো বাস করে, ভীতু করুণ চোখে তফাত হইতে শশীর চালচলন লক্ষ করে, অপরকে জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া শশীর মতলবাদির সন্ধান নেয়। সামনাসামনি শশীর সঙ্গে কথা বলিবার সাহসও গোপাল পায় না! কে জানে কী বলিতে কী বলিয়া বসিবে তার দুরন্ত অবাধ্য ছেলে কোথায় যাইতে চায় শশী, কী করিতে চায় সঠিক খবর কেহ গোপালকে দিতে পারে না, তবে ব্যবস্থা দেখিয়া সকলে অনুমান করে যে দু-চার দশদিনের জন্য সহজ সাধারণ যাওয়া নয়, যাওয়াটা শশীর যাওয়ার মতোই হইবে।
তারপর একদিন শশীর চিঠির জবাবে হাসপাতালের চাকরির জন্য দরখাস্তকারীদের মধ্যে একজন গ্রামে আসিয়া পৌঁছিল। নাম তার অমূল্য, শশীর সঙ্গে একই বছর পাস করিয়া বাহির হইয়াছে। নাম শশীর মনে ছিল না, এখন দেখা গেল শশীর সে চেনা। অমূল্যের সঙ্গে আলাপ করিয়া শশীর ভালো লাগিল, তা ছাড়া এই সামান্য চাকরির দাবি লইয়া উপস্থিত হইলে বন্ধুকে কে ফিরাইতে পারে? লোক বাছিবার আর প্রয়োজন রহিল না, কয়েকদিন পরে পরে যাদের আসিবার জন্য তারিখ দেওয়া হইয়াছিল, তাদের বারণ করিয়া চিঠি লিখিয়া দেওয়া হইল।
নিজের বাড়িতেই অমূল্যকে একখানা ঘর শশী ছাড়িয়া দিলা বলিল, একদিন আমার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতে হবে অমূল্য, রোগীদের চিনে সব বুঝে-শুনে নেবে-এবার থেকে সমস্ত ভার তোমার। গাঁয়ের যারা তোমায় ডাকবে তাদের অধিকাংশ বড় গরিব, ফি-টা তাচ্ছিল্য করিতে শিখো। যার যা ক্ষমতা নিজে থেকেই দেবে, গায়ের লোক ডাক্তারকবরেজকে ঠকাতে সাহস পায় না।