তা না নিক শশী মাহিনা বাদে কিছু এখন সেটা আর আসল কথা নয় গোপালের কাছে, ছেলের সঙ্গে একটু সে আলাপ করিল মাত্র। এমনি নারীসুলভ একধরনের ছলনায়ময় ব্যবহার গোপালের আছে, শশীকে মাঝে মাঝে যা আশ্চর্য ও অভিভূত করিয়া দেয়। ভোলা ব্রহ্মচারীকে শশী কথার কথা বলে নাই, গোপালের প্রতি একটা অন্ধ ভয়মেশানো ভক্তি আজও তার মধ্যে অক্ষয় হইয়া আছে-হয়তো চিরদিনই থাকিবে। গোড়ার দিকে অনেকগুলি বছর ধরিয়া তার মনের সমস্ত গাথুনি যে গাথিয়াছিল গোপাল, সেগুলি ভাঙিতে পরিবে কে?
কায়েতপাড়ার পথ দিয়া চলিবার সময় এক-এক দিন শশী যামিনী কবিরাজের বাড়িতে শিশুর ক্ৰন্দন শুনিতে পায়। কচি গলার কান্না। খুবই যেন কচি মনে হয় গলাটা শশীর। বিপিনের কি এক ছোট শিশু আছে? অনেকদূর চলিয়া গিয়াও অনেকক্ষণ অবধি কান্নার সুরটি শশীর কানে বাজিতে থাকে। নিজের এই ভাবপ্রবণতা ভালো লাগে না। যে শিশু জনিয়াছে সে মাঝে মাঝে কাঁদিবে বৈ কি! তাতে এতখানি বিচলিত হওয়ার কী আছে? নিজের বাড়িতেও এমন কান্না সে কত শোনে।
সেনদিদির মারা যাওয়ার মাস তিনেক পরে একদিন অনেক বেলায় শশী ফিরিয়াছে, এমনি কান্নায় রত একটি শিশুকে বুকে করিয়া কুন্দ শশীর কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। বলিল, সেনদিদির ছেলে শশীদাদা।
রোদের তেজে অস্নাত অভুক্ত শশীর মুখখানা শুকনো দেখাইতেছিল, আরও একটু পাংশু হইয়া সে বলিল, কার ছেলে বললি কুন্দ, সেনদিদির?
কুন্দ বলিল, হ্যাঁ। পেট থেকে পড়েই তো মাকে খেয়েছে রাক্ষস, কিপানাথ কবরেজের শালীর কচি ছেলে আছে, তার মাই খেত। সে আজ চলে গেল কিনা, মামা তাই আমাকে এনে দিলেন। খুকির সঙ্গে আমার দুধ খাবে। মার মতো শেষে আমাকেও না খায়!
একগাল হাসিল কুন্দ, সেনদিদির কাথা-জড়ানো ছেলে শশীর সামনে মেলিয়া ধরিয়া বলিল, ওকে মানুষ করার জন্য সোনার হার পাব শশীদাদা। মামার মন আজকাল বড় দরাজ হয়েছে।
ওকে আনলে কে?
মামাই আনল। এমনি কথা জড়িয়ে বুকের কাছটিতে ধরে। বাড়ির ছেলেমেদের কাছে ঘেঁষতে দেয় না, পরের ছেলে কোলে নেবার মামার রকম দেখে হেসে হেসে বাঁচি না। আমায় কী বললেন জানেন?–ছেলেটা নিলামরে কুন্দ আমি, মানুষ করতে পারবি? তোকে দশভরির হার গড়িয়ে দেব। আমি বললাম, দিন না মামা, আমার ছেলেমেয়ের সঙ্গে মানুষ হবে, এতে আর হাঙ্গামা কী?
শশী ঝাঝিয়া বলিল, কেন তুই এ ভার নিতে গেলি? এত গয়নার লোভ তোর!
কুন্দ অবাক হইয়া বলিল, গয়নার লোভে বুঝি? অতটুকু মা-মরা শিশু, কেউ না দুধ দিলে বাঁচবে কেন? মামি-টামি কারো কচি ছেলে নেই। সেকথা যদি বাদ দেন, মামা বললে আমি তো না বলতে পারি না।
সন্দিগ্ধভাবে তাকায় কুন্দ, খানিক বোঝে খানিক বোঝে না। এতক্ষণ পরে শশী হঠাৎ জামাকাপড় ছাড়িতে আরম্ভ করিল। কুন্দ জিজ্ঞাসা করিল, এত রাগলেন কেন শশীদাদা?
না, রাগিনি।
সেনদিদির ছেলে কান্না থামাইয়াছিল। কুন্দ তাকে একটা চুমো খাইল,—সস্নেহে, গৌরবের সঙ্গে। কে জানে কী দুষ্টামি আছে কুন্দর মনে তারপর ছেলেকে আর একবার শশীর দিকে বাড়াইয়া দিয়া বলিল, কী সুন্দর হয়েছে ছেলেটা দেখুন শশীদাদা, সেনদিদির মতো দেখতে হবে। মুখখানা দেখলে মায়া হয় না?
শশী শ্রান্তভাবে বলিল, তুই যা তো কুন্দ। ঘেমেচেমে হয়রান হয়ে এলাম, একটু বিশ্রাম করতে দে।
কার উপরে রাগ করিবে শশী, কাকে বলিবে? সেনদিদির ছেলে যে সুন্দর হইয়াছে তাতে সন্দেহ নাই, আশ্চর্যরকম সুন্দর হইয়াছে; সেনদিদির যে জমজমাট রূপ বসন্ত হরণ করিয়াছিল ছেলের মধ্যে যেন তার ক্ষতিপূরণ হইয়াছে সুদসমেত। এতটুকু ছেলে, কাচা সোনার মতো কী তার রঙ। ওর মুখ দেখিয়া গোপালের যদি মায়া হইয়া থোকে, মায়া করিয়া গোপাল যদি এই অনাথ শিশুকে বুকে তুলিয়া ঘরে আনিয়া থাকে, তাতে কার কী বলিবার আছে? এ তো মহত্ত্ব, প্রশংসনীয় কাজ। ক্ষোভে দুঃখে এজন্য এমন কাতর হওয়া তো শশীর উচিত নয়।
সেনদিদির ফুলের মতো শিশুকে দেখিয়া একটু কি মায়া হইল না শশীর মায়া করার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি কি তার এমনভাবে নষ্ট করিয়া দিয়া গিয়াছে কুসুম? গম্ভীর বিষন্নমুখে শশী স্নান করিতে গেল, সেনদিদির ছেলেকে কোলে করিয়া কুন্দ অদূরে আসিয়া বসায় ভালো করিয়া খাওয়া পর্যন্ত হইল না শশীর। অল্পে অল্পে শরীরটা তাহার কিছু ভালো হইয়াছে, কী ক্ষুধাই আজ পাইয়াছিল!
সমস্ত দুপুরটা শশী নিঝুম হইয়া রহিল। এবার কিছু করিতে হইবে তাহাকে, আর চুপ করিয়া থাকা নয়। আর গরমিল চলিবে না। স্তব্ধ দ্বিপ্রহরে নিস্তেজ শয্যাশায়ী শশীর মনে অসংখ্য এলোমেলো ভাবনা বিস্ময়করভাবে শৃঙ্খলাবদ্ধ হইয়া আসিতে থাকে, কোমল মমতাগুলির আলগা ফুলের মতো ঝুরঝুর করিয়া ঝরিয়া যায়। আগুনের আচে সরস বস্তুর শুকাইয়া যাওয়ার মতো নিজে সে রুক্ষ প্রকৃতির মানুষ হইয়া উঠিতেছে এমনি একটা অনুভূতি শশীর হয়। একেবারে বেপরোয়া, নির্মম, অবিবেচক কুসুমের জন্য মন কেমন করিত শশীর। বড় আকুলভাবে মন কেমন করিত। এতবড় উপযুক্ত ছেলের মর্যাদায় ঘা দিয়া মনকে কী করিয়া দিয়াছে গোপাল যে সেই মন-কেমন-করাকে আজ হাস্যকর মনে হইতেছে? সে যে-বাড়িতে বাস করে অবানবদনে সেনদিদির ছেলেকে সেখানে গোপাল কেমন করিয়া আনিল? সেনদিদিকে মরমর জানিয়াও শশী যে তার চিকিৎসা করিতে যাইতে চাহে নাই গোপাল কি সে কথা ভুলিয়া গিয়াছে? শশীর অভিমান এতই তুচ্ছ গোপালের কাছে, সে কী ভাবিবে না ভাবিবে সেটা এতখানি অবহেলার বিষয়! শশীর কাছে তার একটু সংকোচ করিবারও প্রয়োজন নাই? ছেলের সম্বন্ধে এমনি ধারণা গোপালের যে সে ভাবিয়া রাখিয়াছে সেননিদির ছেলেকে বাড়িতে আনিয়া পুত্রয়েহে মানুষ করিতে থাকিলেও শশী চুপ করিয়া থাকিবে, গ্রাহ্যও করিবে না। কে জানে, গোপালই হয়তো গ্রাহ্য করে না শশী চুপ করিয়া থাক অথবা গোলমাল করুক।