কুন্দ অবাক। বলে, হঠাৎ কাপড় কেন দাদা?
শশী গম্ভীরমুখে বলে, দেব, তোকে একখানা কাপড় দেব। এমনি দেব কুন্দ, মিছিমিছি।
মিছিমিছ কুন্দকে শশী কাপড় কিনিয়া দেয়। এদিকে আবির্ভাব ঘটে গোপালের গুরুদেবের। ভোলা ব্রহ্মচারী নামে তার খ্যাতি। সুপুষ্ট লোমশ দেহ, মাথা গোঁফদাড়ি ভ্র সব কামানো, হাতে কুচকুচে কালো একটি দণ্ড। গায়ে গেরুয়া, পায়ে গেরুয়া-রঙ-করা রাবার-সোলের ক্যাম্বিশ জুতা। বছর পাঁচেক একে গোপাল একরকম ভুলিয়াই ছিল, হঠাৎ এমন ব্যাকুলভাবে স্মরণ করিয়াছে যে ভগবানকে করিলে হয়তো তিনিও দেখা দিতেন। সসম্মানে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করিল, স্বহস্তে পা ধোয়াইয়া দিল। অন্দরের একখানা ঘর আগেই ধুইয়া মুছিয়া পরিষ্কার করিয়া রাখা হইয়াছিল, সেখানে ভোলা ব্রহ্মচারীকে থাকিতে দেওয়া হইল। ব্রহ্মচারীকে শশী ভক্তি করিত, এসময় হঠাৎ তাহার আগমনে বিশেষ খুশি না হইলেও শ্রদ্ধার সঙ্গে একটা প্রণাম করিল।
ব্ৰহ্মচারী দিন সাতেক রহিয়া গেল। এই সাতদিন একমুহুর্তের জন্যও গোপাল তাহার সঙ্গ ছাড়িল না। কত প্রশ্ন গোপালের, কত ব্যাকুল নিবেদন। গোপালের অবহেলায় বাজিতপুরের কোর্টে একটা মামলা ফাঁসিয়া গেল। তা যাক, মনে বৈরাগ্য আসিয়াছে, ওসব মামলা-মোকদ্দমা বিষয়কর্ম তার কাছে এখন তুচ্ছ। শুধু সেনদিদির জন্য তো নয়, আজ কতকাল হইল গোপালের মনে ভাবনা ঢুকিয়াছে, কিসের জন্য এসব। কার জন্য সে এতকষ্টে অর্থসম্পদ সংগ্ৰহ করিতেছে। একটা মেয়ে আছে সিন্ধু, দুদিন পরে ওর বিবাহ দিলে পরের ঘরে চলিয়া যাইবে, তখন কে থাকিবে গোপালের? শশী? শশীর কাছে কোনো আশাভরসাই সে রাখে না। বাপকে যে ছেলে ঘৃণা করে, তার কাছে কী প্রত্যাশা থাকে বাপের? ধরিতে গেলে সেই তো মনটা ভাঙিয়া গোপালের।
এ বড় আশ্চর্য কথা যে কুসুমের মতো গোপালের মনটাও শশীই ভাঙিয়া দিয়াছে। এ দুজনের মনের মতো হইতে না-পারার অপরাধটা শশীর এতবড় ভাঙা মনটা লইয়া কুসুম সরিয়া গিয়াছে। গোপাল আজও হাল ছাড়ে নাই। ব্রহ্মচারীর কাছে মনোবেদনা ব্যক্ত করিয়া সে তফাতে যায়, ব্রহ্মচারী ডাকেন শশীকে।
বাবা শশী, তুমি বিদ্বান বুদ্ধিমান, তোমাকে বলাই বাহুল্য যে খেয়ালের চেয়ে কর্তব্য অনেক বড়।
আজ্ঞে হ্যাঁ।
বাপকে ভক্তিশ্রদ্ধা করার চেয়ে বড় কর্তব্য ছেলের আর কী আছে?
ঠিক এমনিভাবেই বলেন ব্রহ্মচারী, এমনি ভূমিকাবিহীন কঠোর ভাষায় কথাটা তাই বড় জোরালো হয়। শশী আহত হইয়া বলে, বাপের প্রতি ওটাই ছেলের প্রথম কর্তব্য বইকী। ছেলের মনের ওটা স্বাভাবিক ধর্ম বাবা, যুক্তিতর্কে বোঝানোর জিনিস নয়। বাপের স্বভাব মন্দ হলে ছেলে হয়তো বড় হয়ে তাকে সমালোচনা করে কিন্তু যেমন বাপই হোক ছেলের মনের অন্ধভক্তিটা কিছুতেই যাবার নয়।
কম নয় শশী, গুরুকে সে গুরুর মতো বোঝায়। সাত-আট বছর আগে ভোলা ব্রহ্মচারীর কাছে গোপাল তাহার দীক্ষা দিয়াছিল, ওঁ স্থানে নমো বলিয়া গুরুর মন্ত্র কিছুদিন শশী জপও করিয়াছে, তারপর কত পরিবর্তনই হইয়াছে শশীর!
সংক্ষেপে পরিচ্ছন্নভাবে তারপর অনেক জ্ঞানগর্ভ কথাই ব্রহ্মচারী বলেন, শ্রদ্ধার সঙ্গে শুনিয়া শশীও জ্ঞানগর্ভ জবাব দেয়। মনে মনে সে টের পায় যে গুরুর চেয়ে জ্ঞানটা তার অনেক বেশি বাড়িয়া গিয়াছে, কিন্তু এটা সে প্রকাশ পাইতে দেয় না। শশীকে ব্রহ্মচারীর বড় ভালো লাগে। ছেলের সম্বন্ধে যেসব অভিযোগ গোপাল করিয়াছিল সমস্ত ভুলিয়া গিয়া অনেককালের সঞ্চিত বাধাধরা উপদেশগুলি নেপথ্যে রাখিয়া নানা বিষয়ে শশীর সঙ্গে আলাপ করেন। ক্রমে ক্রমে মনে হয় অনেকগুলি বছর আগে তাদের মধ্যে যে গুরুশিষ্যের সম্পর্কটি স্থাপিত হইয়াছিল, আজ তাহা বাতিল হইয়া গিয়াছে ধর্মের কথা নয়, ইহকালপরকাল পাপ-পুণ্য সম্বন্ধে প্রশ্নোত্তর নয়, এবার তাদের মুখোমুখি বসিয়া শুধু গল্প করা, অসমবয়সী দুটি বন্ধুর মতো। দুটি দিন এখানে বাস করিতে-নাকরিতে শশীর কাছে একটা মুখোশ যেন ভোলা ব্রহ্মচারীর খসিয়া গেল, ভিতরের আসল মানুষটির সঙ্গে শিষ্যের তিনি পরিচয় ঘটিতে দিলেন। আপনভোলা সদাশিব মানুষ, অনেকটা যাদবের মতো ঘটনাচক্রে তিনি ব্রহ্মচারী, সাধ করিয়া নয়— তারপর অভ্যাস হইয়া গিয়াছে। ক্রমে ক্রমে জীবনের দু-একটি ঘটনা ও সম্ভাবনার কাহিনী শশীকে তিনি শোনান। প্রথম যৌবনে প্রথম সন্ন্যাসী-জীবনের কথা, ঘরে যা মেলে নাই তারই অন্বেষণে দেশে দেশে যাযাবর বৃত্তি। অনিশ্চিতের সন্ধানে বাহির হওয়ার এমনি সব কাহিনী চিরদিন শশীকে ব্যাকুল করে। তারও অনেক দিনের বাহির হওয়ার সাধ।
গোপালের অনুরোধে শশীর মনটি ঘরের দিকে টানিবার চেষ্টা করিতে গিয়া তার ঘর ছাড়ার প্রবৃত্তিকেই ব্রহ্মচারী উস্কাইয়া দিয়া গেলেন।
দিন সাতেক গুরুসঙ্গ করিয়া গোপাল যেন একটু গা ঝাড়া দিয়া উঠিল। নিজের সঙ্গে কিছু সে একটা রফা করিয়া ফেলিয়া থাকিবে, কারণ দেখা গেল কর্তব্য সম্পাদন ও শশীর প্রতি ব্যবহার তার সহজ্ঞ ও স্বাভাবিক হইয়া আসিয়াছে।
বলে, হাসপাতালে রোগীপত্র কেমন হচ্ছে শশী?
শশী বলে, বাড়ছে দু-একটি করে।
গোপাল আপসোস করিয়া বলে, বেগার খেটেই তুমি মরলে। মাইনে হিসেবে কিছু কিছু নাও না কেন? পরিশ্রমের দাম তো আছে তোমার, একটা লোক রাখলে তাকে তো দিতে হত?
শশী বলে, হাসপাতালের টাকা কোথায় যে নেব বাবা? সামান্য টাকার হাসপাতাল, আমিও যদি নিজের পাওনা গণ্ডা বুঝে নিতে থাকি, হাসপাতাল চলবে কিসে?