শশী জানে এরকম হয়, মানুষের দেহের মধ্যে আজও এমন কিছু ঘটিয়া চলে এ যুগের ধম্বন্তরিরও যা থাকে জ্ঞানবুদ্ধির আগোচর। এ তো মানুষের বানানো কল নয়। তবু শশীর রাতজাগা চোখের আরক্ত ভাব যেন বাড়িয়া গেল, অবসাদ যেন হইয়া উঠিল অসহ্য। আর কিছু করিবার ছিল না, বাড়ি গিয়া স্নান করিয়া শশী কড়া এককাপ চা খাইল, তারপর শুইয়া পড়িল। আসিবার সময়ও বাহিরে গোপালকে সে দেখিয়া আসিয়াছে।
চেনা ও জানা মানুষগুলির মধ্যে দু-চারজনকে শশী যেমন মরিতে দেখিয়াছে, তেমনি তাদের ঘরে দু-চারজনকে জন্ম লইতেও দেখিয়াছে। দু-চারজন মরিবে দু-চারজন জন্ম লইবে এই তো পৃথিবীর নিয়ম। তবু এসব মরণ, মরণেঅভ্যস্ত শশী ডাক্তারকে বড় বিচলিত করে। যারা মরে তারা চেনা, স্নেহে ও বিদ্বেষে দীর্ঘকালব্যাপী সম্পর্ক তাদের সঙ্গে, যারা জনায় তারা তো অপরিচিত। এই কথা ভাবে শশী ; সেনদিদি কি বাঁচিত, সে যদি অন্যভাবে চেষ্টা করিত, যদি অন্য ওষুধ দিত? শেষের দিকে সে যে ব্যস্তভাবে গোটা দুই ইনজেকশন দিয়াছিল রোগিণীর পক্ষে তা কী অতিরিক্ত জোরালো হইয়াছিল? হইয়া থাকিলেও তাহার দোষ কী? অনেক বিবেচনা করিয়া তবে সে ইনজেকশন দুটো দিয়াছিল, তা ছাড়া আর কিছুই তখন করিবার ছিল না। নিজের জ্ঞানবুদ্ধিতে যা ভালো বুঝিয়াছে তাই সে করিয়াছে, তার বেশি আর সে কী করিতে পারে? আজ পর্যন্ত সে যে অনেকগুলি প্রাণ রক্ষা করিয়াছে সেটাও তো ধরিতে হইবে?
গোপাল একেবারে মুহ্যমান হইয়া গেল। এমন পরিবর্তন আসিল গোপালের যে সকলের সেটা নজরে পড়িতেছে বুঝিয়া শশীর লজ্জা করিতে লাগিল। গোপাল চিরকাল ভোজন-বিলাসী, এখন তার আহারে রুচি নাই; অমন চড়া মেজাজ, কিন্তু মুখ দিয়া আর কড়া কথা বাহির হয় না। গম্ভীর বিষণ্ণমুখে বাহিরের ঘরে ফরাশে বসিয়া তামাক টানে আর আবশ্যক অনাবশ্যক নথিপত্র ঘাঁটে, যেগুলি গোপালের কাছে এতকাল নাটক নভেলের মতো প্রিয় ছিল। মন হয়তো বসে না গোপালের, তবু এই অভ্যস্ত কাজের মধ্যে ডুবিয়া থাকিয়া সে সময় কাটানোর চেষ্টা করে। শশী আশ্চর্য হইয়া যায়। এসব তার কাছে একান্ত খাপছাড়া লাগে। অপ্রত্যাশিত যত কিছু ঘটিয়াছে শশীর জীবনে, তার মধ্যে গোপালের চরিত্রের এই বেমানান দিকটা সবচেয়ে বিস্ময়কর মনে হয়।
শশীর সঙ্গে কথাবার্তা গোপালের খুব কমই হয়। দুজনের দুটি জগৎ যেন এতদিনে একেবারে পৃথক হইয়া গিয়াছে। একদিন আচমকা গোপাল জিজ্ঞাসা করিল, তোমার সেনদিদি কিসে মরল শশী?
হার্ট খারাপ ছিল।
গোড়ায় বুঝি ধরতে পারো নি?
গোড়াতেই ধরেছিলাম।
তবে মরল যে।
এ প্রশ্নে শশী হঠাৎ রাগিয়া গেল। বলিল, গোড়ায় রোগ ধরতে পারলেও মানুষ মরে।
গোপাল বলিল, ইনজেকশন দুটো আগে দাওনি বলে হয়তো—
এটুকু বলিয়া উৎসুকভাবে গোপাল খানিকক্ষণ শশীর মন্তব্যের প্রতীক্ষা করিয়া রহিল। কী সত্য সে নির্ণয় করিতে চায় কে জানে—শশী একেবারে স্তম্ভিত হইয়া যায়। খুঁটিয়া খুঁটিয়া তার চিকিৎসার আগাগোড়াই হয়তো গোপাল জানিয়া লইয়াছে। কী ভাবিয়াছে গোপাল? চিকিৎসক-পুত্রের সম্বন্ধে কী ভাবনা তার মনে আসিয়াছে? মুখখানা লাল হইয়া যায় শশীর। কিছু বলিতে ভরসা পায় না।
কৃপানাথ বলছিল সময়মতো দু-একদানা মৃগনাভি দিলে—
শশী এবার নীরবে উঠিয়া চলিয়া গেল। রাগও হয়, মমতাও বোধ করে শশী। বিষয়ী, সংসারী পৌঢ়বয়সী মানুষ, তার এ কী ছেলেমানুষি। কুন্দ জিজ্ঞাসা করে, মামার কী হয়েছে, শশীদাদা? একটু মেহব্যাকুল সুরেই জিজ্ঞাসা করে। কুন্দর ছেলেটির বড় কঠিন অসুখ হইয়াছিল। অনেক চেষ্টায় শশী তাকে ভালো করিয়া তুলিয়াছে। পাকা দালানে একখানা ঘরও দেওয়া হইয়াছে কুন্দকে, আর দেওয়া হইয়াছে সংসার-পরিচালনার কিছু কিছু দায়িত্ব। মুখরা কুন্দ একেবারে বদলাইয়া গিয়াছে। কত সামান্য কামনা থাকে এক-একটি স্ত্রীলোকের, যার অভাবে স্বভাবটি হইয়া ওঠে হিংস্র খিটখিটে! শশীরও আজকাল মনে হয় ; না, কুন্দর প্রকৃতি তেমন মন্দ নয়, মোটামুটি ভালোই মেয়েটা। নিজের কাজের চাপে আজকাল আর বেশি নজর দিবার সময় পায় না, কুন্দ যে সিন্ধুকে বেশ যত্ন-টত্ব করে তাতে শশী আরও খুশি হয়।
কুন্দর প্রশ্নের জবাবে সে বলে, আমি জানি না কুন্দ।
কুন্দ বলে, আপনি বিয়ে টিয়ে করবেন না, কাল আমার কাছে বড় দুঃখ করছিলেন।
শশী বলে, বাবা দুঃখ করছিলেন, না তুই বাবার কাছে দুঃখ করছিলি?
কুন্দ একটু হাসিয়া বলে, আমরা দুজনেই করছিলাম।
শশী অবাক হইয়া তাকায় কুন্দর দিকে। এমন খাপসই আলাপ কুন্দ শিখিল কোথায়? হঠাৎ শশীর মনে হয় কুন্দ যেন বড় সুখী, ওর জীবনটা যেন আনন্দে পরিপূর্ণ।একটু ভাবপ্রবণ কুন্দ, একটু ঈৰ্ষাপ্রবণও বটে, শাড়ি গহনার লোভটাও বেশ একটু প্রবল, স্বামী তার গোপালের মুহুরিদের সঙ্গে মিশ খাইয়া গিয়াছে, তবু কুন্দ এত সুখী যে শখ করিয়া দুটো-একটা কৃত্রিম দুঃখ বানাইয়া সে উপভোগ করে, তার অভাব অভিযোগগুলিও তাই। কুন্দর অস্তিত্ব এতকাল শশীর কাছে ছিল জড়বস্তুর মতো নিরর্থক, আজ ওর অর্থহীন জীবনে এমন সুখের সমাবেশ দেখিয়া সে যেন খানিকটা ভড়কাইয়া গেল। কী যেন করিয়া দিয়া গিয়াছে শশীকে কুসুম। সামনে আসিলেই মানুষের চোখেমুখে ব্যাকুল চোখে কী যেন শশী খোজে। মুখে হাস্যচ্ছটা দেখিলে, চোখে আনন্দের ছাপ দেখিলে শশীর মন জুড়াইয়া যায়! সজল চোখে ক্লিষ্ট কাতরমুখে যে দাঁড়ায় শশীর সামনে তাকে শশীর মারিতে ইচ্ছে হয়। হঠাৎ কুন্দকে বড় ভালো লাগে শশীর। সস্নহে বলে, তোর কী চাই বল তো কুন্দ? খুব ভালো একখানা কাপড় নিবি? বেনারসী?