শশী রাগিয়া আগুন হইয়া বলিল, তুই আমার সঙ্গে ইয়ার্কি দিচ্ছিস নাকি কুন্দ?
কুন্দ থতথত খাইয়া গেল। তারপর কাঁদিয়া বলিল, দুটি খেতে পরতে গিচ্ছেন বলে আমি কথা কইলেই আপনি রেগে যান। কী করেছি আপনার আমি? এর চেয়ে আমায় তাড়িয়ে দিন শশীদাদা, আমি যেখানে হোক চলে যাই।
শশী নরম হইয়া বলিল, আজেবাজে কথা বলিস তাই তো রাগ হয়।
কুন্দও কান্না সহজে থামে না! সে কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, আজেবাজে কথা কখন বললাম, কখন ইয়কি দিলাম? একবার চিকিৎসা করে ওঁকে বাঁচিয়েছিলেন, তাইতো বললাম দেখতে যাবেন কিনা। তাও দোষের হয়ে গেল?
শশী আরও নরম হইয়া বলিল, শরীরটা ভালো নেই কুন্দ, গা-হাত পা ব্যথা করছে, কাঁদিস না। হাতের কাজটা চটপট শেষ করে দিকি, শুয়ে পড়ি।
রাত প্রায় বারোটার সময় শশীর দরজা ঠেলিয়া গোপাল আস্তে আস্তে ডাকিল, শশী? শশী ঘুমোলি?
অসুস্থ শরীরের তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবটা এতক্ষণে শশীর ঘুমে পরিণত হইতেছে, জাগিয়া সাড়া দিতে গোপাল দরজা খুলিতে বলিল। শশী উঠিয়া দরজা খুলিয়া দিল। গোপালের হাতে আলো ছিল, মেঝেতে সেটা নামাইয়া দিয়া সে বসিল খাটে। গোপাল স্তব্ধ, বিষন্ন, গম্ভীর; মনে হয় কথা সে কিছুই বলিবে না, নির্বাক আবেদনের ভঙ্গিতে এমনিভাবে মধ্যরাত্রে বসিয়া থাকিবে ছেলের ঘরের সামনে!
শশীই শেষে বিরক্ত হইয়া বলিল, আমার ঘুম পাচ্ছে।
গোপাল বলিল, ঘুম পাচ্ছে? তা পাবে বইকী, রাত কি কম হল! শরীরটাও তো তোমার ভালো নেই। একটা মানুষ মরে যাচ্ছে, তাই, নইলে তোমায় ডাকতাম না শশী।
শশী চুপ করিয়া রহিল। গোপাল ব্যগ্রভাবে বলিল, যাবি না একবার? শুধু তো মরবে না শশী, কী যন্ত্রণাই যে পাচ্ছে।
শশী বলিল, বাজিতপুর থেকে ওরা ডাক্তার আনাল না কেন। বিকেলে লোক পাঠালে এতক্ষণে এসে পৌঁছত!
গোপাল বলিল, সে বুদ্ধি কারো হয়নি। তুই গাঁয়ে থাকতে বাজিতপুরে ডাক্তার আনতে লোক পাঠাবেই বা কেন? তোর চেয়ে তারা তো বেশি জানেশোনে না। ডাকলে তুই যে যাবি না, ওরা তা ভাবতেও পারেনি শশী। কৃপানাথ এখন আমার হাতে-পায়ে ধরে কাঁদাকাটা করছে বাবা। তুই অপমান করে তাড়িয়ে দিলি, তাই তোর কাছে আসতে আর সাহস পাচ্ছে না।
শশীর ভয়ানক কষ্ট হইতেছিল, সে মৃদুস্বরে বলিল, মান-অপমান তো আমারও আছে বাবা।
গোপাল বলিল, না, না, তোকে অপমান করেনি শশী। না-বুঝে যদি একটা কথা বলে থাকে, কথা গোপাল শেষ করে না। তারপর দুজনেই চুপ করিয়া থাকে। উশখুশ করে গোপাল, করুণ চোখে সে তাকায় শশীর দিকে, মেরজাই-এর ফিতাটা টান দিয়া খুলিয়া বুকটা উদলা করিয়া দেয়, খাইয়া উঠিয়া পান মুখে দিবার সময় পায় নাই, তবু হয়তো অভ্যাসে, হয়তো মানসিক চাঞ্চল্যে, মুখের শূণ্যতাটা পানের মতো বারকয়েক চিবাইয়া দেয়। বড় অদ্ভুত রকমের শ্রীহীন দেখায় গোপালকে।
গোপাল যে নিজেই তাহাকে অনুরোধ করিতে আসিতে পারবে শশী এটা ভাবিতে পারে নাই। এতবেশি সেনদিদির জীবনের মূল্য গোপালের কাছে? একদিন ওর চিকিৎসা করিতে কেন তবে সে তাকে বাঁধা দিয়াছিল? গভীর দুঃখ ও লজ্জায় শশীর মন ভরিয়া গিয়াছিল, তবু সে মনে-মনে আশ্চর্য হইয়া গেল। বসন্তু যখন রূপ মুছিয়া লইয়া গেল সেনদিদির তখন মমতা আসিল গোপালের, এমন গভীর অবুঝ স্নেহ।
তারপর শশী বলিল, যান, শোবেন যান আপনি। আমি যাচ্ছি ও-বাড়ি জামাটা গায়ে দিয়ে।
গোপাল নিরুত্তরে উঠিয়া গেল। মুখ দিয়া আর তাহার কথা বাহির করার ক্ষমতা ছিল না। শশী তাহাকে অনেক কষ্ট দিয়াছে, আজ যে কষ্ট দিল তার তুলনা হয় না। কৃপানাথ যখন ডাকিতে আসিয়াছিল তখন যদি শশী সেনদিদিকে দেখিতে যাইত, এ লজ্জাটা তবে গোপালের থাকিতে পারিত নেপথ্যে।
এভাবে যখন তাহাকে যাইতেই হইল, সেনদিদিকে বাঁচানোর চেষ্টাটা শশী বিশেষ সমারোহের সঙ্গেই করিয়া দেখিল। রাতদুপুরে এই বিপদগ্রস্ত বাড়িতে সে আরও একটা অতিরিক্ত বিপর্যয় আনিয়া ফেলিল হুকুম দিয়া ধমক দিয়া সকলকে ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলিল। অনেক জল গরম হইল, লোক পাঠাইয়া হাসপাতাল হইতে ওষুধ যন্ত্রপাতি ও কম্পাউন্ডারকে আনানো হইল, দেখিয়া কে বলিবে কিছুক্ষণ আগেও উদাসীন শশী সেনদিদিকে মরিতে দিতে প্রস্তুত ছিল। আবার তেমন জিদ শশীর আসিয়াছে যার জোরে সেনদিদিকে আগে একবার সে বাঁচাইয়াছিল। সেদিন সে লড়িয়াছিল বাহিরের বাধার সঙ্গে, আজ কি শশীকে লড়িতে হইল অন্তরের বাঁধার সঙ্গে? মুমুর্ষ সেনদিদিকে দেখিয়াও কি শশীর মনে বিতৃষ্ণ মিলাইয়া গেল না? সব তো তারই হাতে, এ দুজনের মরণ বাঁচানো। কী না করিতে পারে শশী? শুধু সেনদিদির নয়, সেনদিদির নবাগত চিহ্নের চিহ্নকেও তো সে চিরদিনের জন্য পৃথিবী হইতে মুছিয়া দিতে পারে। কারো প্রশ্ন করাও চলিবে না কেন এমন হইল। শশী কি শুধু মানুষ বাঁচাইতে শিখিয়াছে, মারিতে শেখে নাই? অতি সহজে, অন্যমনস্ক অবস্থায় ভুল করার মতো করিয়াও, সে তা পারে। বাকি জীবনটা তাতে খুব কি আপসোস করিতে হইবে শশীকে?
শেষ রাত্রে একটি ছেলে হইল সেনদিদির, ভোরবেলা সেনদিদি মরিয়া গেল। এত কম জীবনীশক্তি ছিল সেনদিদির, এত দুর্বল হইয়া গিয়াছিল তার হৃদপিণ্ড, যে, প্রথমে তাকে পরীক্ষা করিয়া শশীর বিশ্বাস হইতে চাহে নাই, সেনদিদিকে দেখিয়া কখনও মনে হয় নাই তার দেহষন্ত্রের আসল ইঞ্জিনটা এমন হইয়া গিয়াছে। তবু, শশীও ভাবিতে পারে নাই এ যাত্রা সে রক্ষা পাইবে না। ডাক্তার মানুষ সে, সেও যেন ভালো করিয়া বুঝিতে পারিল না অজ্ঞান অবস্থা পার হইয়া সেনদিদির যখন শান্ত হইয়া ঘুমাইতে আরম্ভ করা উচিত ছিল হঠাৎ হাত-পা কেন ঠাণ্ডা হইয়া আসিল।