শুধু গ্রাম ছাড়িবার কল্পনা নয়, অনেক কল্পনাই শশীর নিস্তেজ হইয়া আসিয়াছে, তবে গ্রামে বসিয়া থাকিবারও আর কোনো কারণ সে খুঁজিয়া পায় না। হাসপাতালের কাজে বেশ শৃঙ্খলা আসিয়াছে, একজন ডাক্তার নিযুক্ত করিয়া এবার সে বিদায় গ্রহণ করিতে পারে। যাওয়ার কথা প্রকাশ করিলে ঘরে ও বাহিরে একটা হৈচৈ বধিয়া যাইবে, কৈফিয়ত দিতে দিতে, উপদেশ ও উপরোধ শুনিতে শুনিতে বাহির হইয়া যাইবে প্রাণ। এটা এড়ানো চলিবে না। সে তো কুসুম নয় যে, যেদিন খুশি তল্পিতল্পা গুছাইয়া চলিয়া যাইতে চাহিলে এতবড় গ্রামের মধ্যে শুধু ব্যস্ত হইবে একজন।
হাঙ্গামার ভয়টাই যেন শশীকে নিক্রিয় করিয়া রাখিল। মন তো ভালো থাকেই না, শরীরটাও খারাপ। উৎসাহ এবং জীবনীশক্তির রীতিমতো অভাব ঘটিয়াছে।
মাস দুই কাটিয়া গেল। সকালবেলা সূচনা হইয়া একদিন মাঝরাত্রে সেনদিদির অবশ্যম্ভাবী বিপদটি আসিয়া পড়িল।
সত্যই বিপদ। সেনদিদি বুঝি বাঁচে না।
অনেক বয়সে প্রথম সন্তান হওয়াটা হয়তো আকস্মিক সৌভাগ্য বলিয়া ধরা যাইতে পারে, কিন্তু সেটা বিপজ্জনকও বটে। গোপালের বোধহয় এ আশঙ্কা ছিল, গ্রাম ছাড়িয়া এসময় দু-একদিনের জন্যও সে কোথাও যাইত না, সর্বদা খোঁজখবর লইত। যামিনী কবিরাজের বৈঠকখানায় তার সর্বদা যাতায়াত,–যামিনি বাচিয়া থাকিতে শেষের দিকে কখনও যাইত না। সেনদিদির দাদা কৃপানাথ কবিরাজ বড় পোষ মানিয়াছে গোপালের কাছে। লোকটা চিকিৎসাশাস্ত্র পড়িয়াছে ভালো কিন্তু প্রয়োগ জানে না, পশারও নাই। চরক-সুশ্রুতের শ্লোক বলিবার ফাঁকে ফাঁকে সে গোপালের স্তব পাঠ করে কিনা কে জানে, গোপাল তাকে বিশেষ কৃপা করিয়া থাকে। তা না হইলে যামিনী কবিরাজের বাড়িঘরে সপরিবারে বাস করিবার সৌভাগ্য তার বেশিদিন স্থায়ী হইতে পারিত না। গোপাল সেনদিদিকে বলিত, এবার তাড়াও ওদের; সেনদিদি ওদের বলিত, এবার তোমরা এসো। একটা গুরুতর মামলার শুনানি উপলক্ষে গোপাল আজ বাজিতপুরে গিয়েছিল। কোর্টে কাজ থাকিলে সেদিন গোপাল গ্রামে ফেরে না, আজ ফিরিল। রাত্রি প্রায় দশটার সময়।
সেনদিদির খবরটা আসিল গোপাল যখন খাইতে বসিয়াছে,-শশীর সঙ্গে। খবরটা দিল কৃপানাথ স্বয়ং।
এই তো বিপদ দাদা। আপনাকে একবার যেতে হচ্ছে।
গোপাল শুল্কমুখে কাতরভাবে বলিল, আমি গিয়ে কী করব হে?
কৃপানাথ বলিল, একবার যেতে হচ্ছে। একটা বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে—
বুদ্ধি-পরামর্শ? বিপদে বুদ্ধি-পরামর্শ দিতে যাওয়াটা দোষের নয়, গোপাল তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করিয়া উঠিয়া গেল। ধীরস্থির থাকিবার চেষ্টা করেও গোপাল কিন্তু চাঞ্চল্য চাপিতে পারে না। বাড়ির মেয়েরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। মাথা হেঁট করিয়া শশী নীরবে খাইয়া যায়।
ও-বাড়িতে দিয়ে কৃপানাথকে গোপাল কী পরামর্শ দেয় সে-ই জানে, খাইয়া উঠিয়া শশী ঘরে গিয়া বসিতে-না-বসিতে সে আবার আসিয়া হাজির হয়। রলে, তোমাকে একবার যেতে হবে শশী।
শশী বলে, আমাকে অনুগ্রহ করে তুমি বলবেন না।
অ্যাঁ? বলিয়া কৃপানাথ একটু থামে। শীর্ণ মুখখানা তাহার একটু লম্বাটে হইয়া যায়। ভাবিয়া বলে, আমি আপনার পিতৃবন্ধু–
শশী বলে, আপনি যান মশায়, আমার ঘুম পেয়েছে।
কৃপানাথ আবার একটু থামে থতথত ভাবটা কাটিতে একটু সময় লাগে তার। তার সংস্কৃত শ্লোক বলার মতো গড়গড় করিয়া বিপদের কথা বলিয়া যায়, চোখদুটো তার ছলছল করে। শশী না গেলে সেনদিদি বাঁচিবে না, গেলেও বাঁচিবে কি-না ভগবান জানেন, তবু যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ কিনা তাই দয়া করিয়া আপনি একবার চলুন শশীবাবু।
গাঁয়ে আর ডাক্তার নাই, কৃপানাথ নিজে যদিও চিকিৎসক, এসব হাঙ্গামার ব্যাপারে সে বোঝে না। জ্বর-জ্বালা হয়, পাঁচন বড়ি দিয়া চোখের পলকে সারাইয়া দিবে, এ তো তা নয়। শশী ভিন্ন সেনদিদির এখন আর গতি নাই। শুনিতে শুনিতে শশীর মনে পড়ে সেনদিদির সেই বসন্ত হওয়ার ইতিহাস, অসময়ে সাতগাঁর একটি বসত্তরোগীর দেহের বীজাণু দু-মইল মাঠঘাট বাড়িঘর ডিঙাইয়া সেনদিদির দেহে আসিয়া পৌঁছিয়াছিল, যামিনীর চেলা ছিল সাতগাঁর রোগীটির চিকিৎসক। সেদিন এ-বাড়িতে গোপাল আর ও-বাড়িতে যামিনী তাকে সেনদিদির চিকিৎসা করিতে দেয় নাই। কত যুক্তি তর্ক অপমান আস্ফালনের বাঁধা ঠেলিয়া সেনদিদিকে সে বাঁচাইয়াছিল—একরকম গায়ের জোরে। আজ আবার অন্য কারণে সেনদিদি মরিতে বসিয়াছে। আজ তার চিকিৎসা করিতে বাঁধা নাই, নিজে গোপাল ডাকিয়া পাঠাইয়াছে। কেন ডাকিয়াছে? পুত্র বলিয়া এভাবে তাকে ডাকিবার অধিকার কে দিয়াছে গোপালকে? সেনদিদি মরুক বাঁচুক শশী কি গ্রাহ্য করে। এমন কত রোগী শশীর নিজের হাতে মরিয়াছে—সেনদিদি তো আজ শশীর রোগীও নয়। আর সমস্ত কথা সে যদি ভুলিয়াও যায়, যদি শুধু মনে রাখে যে সে ডাক্তার, মরণাপন্ন রোগীর আত্মীয় তাকে ডাকিতে আসিয়াছে, তবু না-যাওয়ার অধিকার তার আছে। দেহ তার অসুস্থ দুর্বল, সমস্ত দিন খাটিয়া খাটিয়া সে শ্রান্ত ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছে, এখন ডাক আসিলে সে ফিরাইতে পারে বইকী। তার কি বিশ্রামের দরকার নাই?
কৃপানাথ ক্ষুণ্ণমনে চলিয়া গেলে আলোটা কমাইয়া শশী খাটে বসিয়া একটা মোটা চুরুট ধরাইল। আজকাল বিড়ির বদলে সে চুরুট খায়।
কুন্দ আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, এখন শোবেন শশীদাদা? মশারি টাঙিয়ে দেব?
শশী বলিল, দে।
মশারির কোণ বাঁধিতে বাঁধিতে বুন্দ বলিল, সেনদিদিকে একবার দেখতে যাবে না শশী দাদা?