আস্তে আস্তে শশী কুসুমের কাছে আগাইয়া গেল।
তোমায় দেখে দাঁড়িয়েছিলাম বউ, ভাবছিলাম কাছে যাবে।
আপনি দাঁড়িয়ে থাকবেন, আমি কাছে যাব?
তাতে কিছু দোষ আছে নাকি! শশী হাসিল, কই, কথা শুধোবার জন্যে তালবনে আর তো আমায় ডাকো না বউ?
কী আর শুধোব? নতুন কিছু কি ঘটেছে গাঁয়ে!
ঘটেছে বইকী! অতবড় হাসপাতাল হল, কেমন চলছে হাসপাতাল, রোগীপত্র কেমন হচ্ছে, এসব তো শুধোতে পারো? আমার সম্বন্ধে তোমার কৌতুহল যেন কমে যাচ্ছে বউ।
এবার কুসুম মিষ্টি করি হাসিল, ওমা, তাই নাকি? তা হবে হয়তো একটা কমে একটা বাড়ে, এই তো নিয়ম জগতের। আকাশের মেঘ কমে, নদীর জল বাড়ে,–নইলে কি জগৎ চলে ছোটোবাবু?
বিবাদ হয় নাই, বিবাদ তাদের হইবার নয়, তবু কুসুমের সম্বন্ধে শশীর মনে ভয় ঢুকিয়াছিল যে ব্যবহার যেন তার কড়া হইয়া উঠিতেছে। তাতে ভয়ের কী আছে শশী জানে না, শুধু কষ্ট হইয়াছিল। এখন খুশি হইয়া শশী বলিল, কৌতুহল কমে কি বাড়ল?
কী জানি কী বাড়ল, একটা কিছু অবশ্যি বেড়েছে।
পরানের কথা জিজ্ঞাসা করিতে আসিয়া শশী এইসব কথা বলিল কুসুমের সঙ্গে। এই দরকারটাই তার যেন বেশি ছিল। তারপর চলিয়া আসিবার আগে সে পরানের খবর জানিতে চাহিল। গলায় ঘা কমিয়াছে পরানের।
কমিয়াছে? ভালোই হইয়াছে। বাজিতপুরের ডাক্তারের ওষুধেই তবে গলার ঘা কমিল পরানের? শশীর ওষুধে বাড়িয়া গিয়াছিল। পরানের এতবড় অন্যায় ব্যবহারের কথা শশী ভাবিতে পারে না। বাড়াইবার সুযোগ দিয়া আর কমানোর সুযোগ দিল না, শশীর ওষুধে যে গলার ঘা বাড়িয়ছিল তাই হইয়া রহিল স্থায়ী সত্য একদিনের জন্য ওষুধ লাগাইতে নাই বা আসিতে নাই তার কাছে?
গলার ঘা ভালো হইয়া গিয়াছে পরানের। শরীর সারে নাই। অতবড় কাঠামো বলিয়া আরও তাকে রোগা দেখায়। একটা টনিক খাইলে পারে। একটু স্ট্রিকনিন দিয়া শশী তাকে এমন টনিক তৈরি করিয়া দিতে পারে যে একমাসে চেহারা ফিরিয়া যাইবে,– রোগা শরীরে অত খাটে, মাসকুলার ফেটিগে স্ট্রিকনিন বড় উপকারী! বলিতে বাঁধে শশীর। কে জানে তার দেওয়া টনিক এক ডোজ খাইয়া শরীর আরও খারাপ হইয়াছে বলিয়া সে যদি আবার বাজিতপুরে সরকারি ডাক্তারের কাছে ছোটে?
শরীরের দিকে একটু তাকাও পরান।—এটুকু বলে শশী।
চাষা তো ছিলাম না ছোটোবাবু, চাষার কাজটা সইছে না।—বলে পরান, বলিয়া সে একটু হাসে, তাও বেশির ভাগ জমি শ্বশুরের কাছে বাঁধা।
শশী বলে, ছেলে তো নেই শ্বশুরের, তিনটি শুধু মেয়ে—যা আছে জামাইদের দিয়ে যাবে। জমি তোমার নামেমাত্র বাঁধা।
পরান প্রকাণ্ড হাই তোলে, বলে, শ্বশুরের ইচ্ছা এখানকার জমিজমা বেচে আমরা তার কাছে গিয়ে থাকি।
যাও না কেন?
তাই কি হয় ছোটোবাবু? গা ছেড়ে বাড়িঘর ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি পড়ে থাকব!
প্রতিধ্বনির মতো শোনায় কথাটা, যেন কার কথা কে বলিতেছে! কোনো বিষয়ে এক জোরালো নিটোল সিদ্ধান্ত পরান তো করিয়া রাখে না। শশী যেন শুনিতে পায় কুসুমের বাবা অন্তত বলিতেছে, চলো মা কুসি, এখানকার সব বেচে দিয়ে আমার ওখানে থাকবি চল তোরা, আর কুসুম জবা দিতেছে, তাই কি হয় বাবা? গাঁ ছেড়ে বাড়িঘর ছেড়ে তোমার ওখানে পড়ে থাকব?
শীত জমিবার আগে এবার যামিনী কবিরাজের কাশিটা চিরতরে থামিয়া গেল, দুদিনের জ্বরে বেচারি গেল মারা। পাঁচন সিদ্ধ করিবার কড়াই পড়িয়া রহিল, আলমারিতে শিশি বোতল টিনের কৌটাভরা নানারকম ওষুধ রহিল, বেড়ায় ঠেকানো রহিল ইকো— বুড়ো যামিনীর হৃদকম্পন আর হামানদিস্তার ঠকঠক শব্দটা গেল থামিয়া। খবর পাইয়া আসিল সেনদিদির দাদা কৃপানাথ-সেও কবিরাজ আসিল সে সপরিবারে, তামাক টানিতে লাগিল যামিনীর হুকায় আর আলমারি খুলিয়া দেখতে লাগিল যামিনীর সঞ্চিত ওষুধ। মনে হইল, যামিনীর পাঁচন-সিদ্ধ হইতে থাকিবে, যামিনীর হামানদিস্তায় আবার শব্দ উঠিবে ঠুকঠুক।
কেবল সেনদিদি আর এ জীবনে সধবা হইতে পরিবে না।
তবে শোনা গেল, সেনদিদির নাকি ছেলে হইবে।
শুনিলে অবশ্য বিশ্বাস করিতে ইচ্ছে হয় না, কিন্তু অবিশ্বাস করিবার উপায় নাই। এ তো কানে-শোনা রটনা নয়, চোখে-দেখা ঘটনা। সেনদিদির অমন রূপ কাড়িয়া চোখ কানা করিয়া দেবতার কী মমতা হইল যে সেনদিদিকে তিনি শেষে একটি ছেলে দিলেন? আহা, দিন জীবনে মানুষের এটুকু ক্ষতি পূরণ না থাকিলে কি চলে সন্ধ্যাবেলা শ্ৰীনাথ মুদির মেয়ে বকুলতলে পুতুল ফেলিয়া গেল, ভোরবেলা সে পুতুল কুড়াইয়া কতকাল আর কাটিবে সেনদিদির।
ম্লান হইল শশী, একেবারে বিষন্ন বিবর্ণ হইয়া গেল। মাথা নিচু-করা বাক্যহীন স্তব্ধতায় সে মূক হইয়া রহিল। কেন, কী হইল শশীর, গাওদিয়ার নামকরা ডাক্তারের, উদীয়মান তরুণ নেতার? সেনদিদি তাকে ছেলের মতো ভালোবাসিত, আর সে বাসে না তারও অকাট্য প্রমাণ কিছুই নাই, আজ যদি ছেলের মতো ভালোবাসিবার জন্য নিজস্ব একটি ছেলে পায় সেনদিদি, তাতে শশী কেন বিচলিত হয়।
গোপাল সভয়ে জিজ্ঞাসা করে, হ্যা রে শশী, তোর তো অসখ-বিসুখ হয়নি বাবা?
শশী বলে, না।
না হলেই ভালো। একটু সাবধানে থাকিস এ সময়।
শশী ডাক্তারকে গোপাল বলে সাবধানে থাকিতে। বলে সবিনয়ে কৃপাপ্রার্থীর মতো। হয়তো গোপালের বলিবার কথা ওটা নয়। শশীর মান, বিষণ্ণ মুখ দেখিয়া হয়তো গোপালের হৃদপিণ্ডটা ধড়াস ধরাস করে, সেই শব্দটা পৌঁছাইয়া দিতে চায় শশীর কানে। আর তো ছেলে নাই গোপালের, শুধু শশী।