গলায় বড় যন্ত্রণা হয় ছোটোবাবু।
শশী মুখ তুলিয়া বলিল, এসো দেখি কাছে সরে। হাঁ করো।
চেয়ারে বসিয়া স্পষ্ট দেখা গেল না, দরজার কাছে আলোতে যাইতে হইল। ভালো করিয়া দেখিয়া শশী বলিল, ঘা-টা ভালো মনে হচ্ছে না পরান। এক কাজ করো তুমি; একটু বোসো, এদের বিদায় করে দিয়ে আবার দেখব।
টুলটার উপর পরান বসিয়া রহিল। একে একে সমাগত রোগীদের দেখা শেষ করিয়া শশী হাসপাতালের দক্ষিণকোণের ছোট ঘরখানায় পরানকে ডাকিয়া লইয়া গেল। এটা তার খাসকামরা। এই খাসকামরাটি উপলক্ষ করিয়া কমিটির সভ্যদের সঙ্গে শশীর একটু মনোমালিন্য হইয়াছিল। গাঁয়ের ছোট একটা হাসপাতালের নগণ্য ও অবৈতনিক ডাক্তার, হাকিম-হুকিমের মতো তার আবার খাসকামরা কিসের? শশী কারো কথা শোনে নাই। স্বার্থপরের মতো এই ঘরখানা সুন্দরভাবে সাজাইয়া লইয়াছে। শশীর মনের গতি কে অনুধাবন করিবে? কমিটির প্রাচীন সভ্যদের তো জানিবার কথা নয় যে হাসপাতালের বেগার-খাটা শশী ডাক্তার দরকারের সময় ছাড়াও হাসপাতালে পড়িয়া থাকিতে ভালোবাসিবে! বাড়িতে শশীর যে মন টেকে না এ কথা এ জগতে বোধহয় শুধু টের পাইয়াছে গোপাল !
পরানের গলায় ঘা শশী যত পরীক্ষা করে ততই তার মুখ গম্ভীর হইয়া আসে। বলে— টোক গেলো পরান, ঢোক গেলো। কেন পারছ না? পারা তো উচিত। আচ্ছা, একটু জল খাও তবে। ঢোক গিলিতে না-পারার মতো অবস্থা তোমার হয়নি পরান, ভয়ে পারছ না।
জল খাইয়া পরান একটু সুস্থ হয়। ঢোকও গেলে, একটু হাসিবার চেষ্টা করিয়া বলে, হঠাৎ কেমন ভয় হল ছোটোবাবু, প্রাণটা কেমন আঁকুপাঁকু করে উঠল।
শশী বলে, না-খেয়ে না-খেয়ে যা শুকিয়েছ প্রাণটাকে, আকুপাকু করবে না? রোজ একবার এসে দেখিয়ে যেও গলাটা, আজ ঠিক বুঝতে পারলাম না। একটা ওষুধ লাগিয়ে দিচ্ছি, বিকালে আর একবারে নিজে লাগিও।
তুলিতে করিয়া পরানের গলায় ওষুধ লাগাইয়া বলে, পারবে দিতে নিজে? না পারো তো কাজ নেই, ও বেলা একবার যাবখন তোমাদের বাড়ি, লাগিয়ে দিয়ে আসব।
পরান বিদায় নেয়। খোলা জানালায় দাঁড়াইয়া শশী তার লম্বা পা দুটির ছোট ছোট পদক্ষেপ চাহিয়া দেখে। তারপর টেবিলের সামনে চেয়ার টানিয়া বসিয়া মোটা একটা ডাক্তারি বই খুলিয়া নিবিষ্টচিত্তে পড়িতে আরম্ভ করে। মাঝে মাঝে মুখ তুলিয়া ভাবে, অন্য বই টানিয়া পাতা উল্টায়, কী একখানা বই খুঁজিয়া লইতে সমস্ত বইয়ের নামের উপর চোখ বুলায়। তারপর অসময়ে ব্যস্তভাবে শশী আজ বাড়ি ফেরে। আলমারি খুলিয়া একখানা বই লইয়া পড়িতে বসে।
বেলা পড়িয়া আসিলে হাসপাতালে যাওয়ার আগে সে পরানের বাড়ি গেল। অনেক দিন যায় নাই। অনেক দিন আর কত, দিন কুড়ি। অবস্থা বিশেষে তাও দীর্ঘকাল হইয়া উঠে। পরান বাড়ি ছিল না। মাঠে গিয়াছে। এখন রবিশস্য বুনিবার সময় দুর্বল শরীরেও মাঠে না গেলে তার চলে না।
কুসুম বলিল, বললাম যেও না, তবু গেল।
বলে গেছে শিগগির আসবে।
শশী বলিল, শিগগির আসবে। শিগগির আসবে বলে হাঁ করে বসে থাকবে নাকি আমি? আমার কাজ নেই?
কাজের মানুষ বুঝি একটুও বসে না? দুদণ্ড আয়েশ করতে বসলে মনে খুতখুতানি ধরে, এ রোগ ভালো নয় ছোটোবাবু। চাকর তো নন কারো, অ্যাঁ?
শশী বলিল, বাড়ি খালি দেখছি? পরানের মা কই?
কুসুম উদাসভাবে বলিল, কে জানে কোথায় গেছে বুড়ি যা পাড়া-বেড়ানি।
শশী সন্দিগ্ধভাবে বলিল, তুমি পাঠাওনি কোথাও, ছল করে?
আমি? আমি পাঠাব?—লজ্জায় মুখ লাল করিয়াও কুসুম একটু হাসিল, বলিল, কী মানুষ বাবা? যদি পাঠিয়েই থাকি ছল করে, এমন স্পষ্ট করে সে কথা বলতে হয়? কীরকম বিচ্ছিরি লাগে শুনলে?
শশী বলিল, আজ তোমার কথা ভারি মিষ্টি লাগছে বউ।
মিষ্টি খেয়ে মুখটা আজ মিষ্টি হয়ে আছে।
শশী খুশি হইয়া বলিল, তোমার হাসি দেখলে প্রাণ জুড়িয়ে যায় বে। লোকজনের ভিড়ে জ্বালাতন হই, তুমি ছাড়া এমন করে আমার কাছে আর কেউ হাসে না। আমার একটিও বন্ধু নেই বউ!
বউও নেই!–কুসুম নিখুঁত পরিপূর্ণ হাসি হাসিল। তারপর সে জিজ্ঞাসা করিল, ওর গলায় কী হয়েছে?
শশী বলিল, আজ বলব না, পরশু শুনো।
কেন, আজ বলতে দোষ কী?
নিজে আগে জেনে নিই ভালো করে তবে তো বলব? দুধ ছাড়া ওকে আর কিছু খেতে দিও না বউ।
আর কিছু খেতে পারলে তা দেব? দুধ খেতেও কষ্ট হয়।
পরানের প্রতীক্ষায় শশী আরও খানিকক্ষণ বসিয়া রহিল। কুসুম আর কথা বলিল না, হাসিলও না। প্রতিপূর্ণ বাক্যের আদানপ্রদান আর কতক্ষণ রেশ রাখিয়া যায়? কুসুম উশখুশ করে। একবার উঠিয়া গিয়া উত্তরের ঘরে চোকে, বাহিরে আসিয়া আকাশে বেলার দিকে তাকায়, তারপর শশীর পাশ দিয়া বড়ো ঘরে ঢুকিবার সময় চাবির গোছাটা শশীর পিঠে ফেলিয়া দিয়া বলে, আহা লাগল?
এবার শশী উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলে, আর বসবার সময় নেই বউ। পরান এলে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিও।
কুসুম কোনোদিন রাগ করে না, আজ ভয়ানক রাগিয়া উঠিয়া চাবির গোছাটা কাঁধে ফেলিয়া মুখ কালো করিয়া বলিল, বসবার সময় নেই, না?
শশী একটু আশ্চর্য হইয়া বলিল, হাসপাতালে রোগী এসে বসে আছে তা তো জানো?
কথাগুলি দুর্বোধ্য নয়, তবু মনে হইল কুসুম যেন চেষ্টা করিয়া মানে বুঝিতেছে। শশী যেন তার অচেনা, এমনি তাকানো কুসুমের।
সে তো রোজ থাকে।–কুসুম বলিল।
শশী বিব্রতভাবে একটু হাসিয়া বলিল, বসতে বলো, বসছি। অমন খামকা রাগ কোরো না বউ। সময়ে কাজ না করলে কাজ নষ্ট নয়, বসে গল্প করা পালায় না। তুমি রইলে আমিও রইলাম—