কুমুদ মৃদুস্বরে হাসিয়া বলে, পাকা গিন্নির মতো করলে যে মতি? কী কথা বলবে?
বলছি দাঁড়াও,—আসছি।
বলিয়া কুমুদকে পর্যন্ত স্তম্ভিত করিয়া দিয়া মতি ল্যাভাটরিতে ঢুকিয়া গেল। গাড়ি ছাড়ার ঘণ্টা পড়িল, গার্ড নিশান দেখাইল, প্ল্যাটফর্মে শশী ও পরাণ অস্থির হইয়া উঠিল, তবু মতি বাহির হইল না। গাড়ি ছাড়িলে গাড়ির সঙ্গে চলিতে চলিতে শশী বলিল, আমরা কেউ উঠব নাকি কুমুদ, পরের স্টপেজে ওকে নামিয়ে নেব?
কুমুদ বারণ করিয়া বলিল, না না, দরকার নেই। আমিই ব্যবস্থা করব শশী।
গাড়ি প্লাটফর্ম পার হইয়া গেলে মতি বাহির হইয়া আসিল। বলিল, এ কী হল? আমি যে নামতে পারলাম না?
কই আর পারলে?
কী হবে তবে?
কুমুদ হাসিয়া বলিল, কিছু হবে না মতি, বোসো। এরকম ছলনা করলে কেন? বললেই হত সঙ্গে যাবে?
মতি বসিয়া বলিল, ওরা ছিল যে, গোলমাল করত।
গাড়ির সমস্ত লোক সকৌতুকে তাহাদের দিকে চাহিয়া ছিল, কারো তা খেয়াল ছিল না। গাড়ির গতি বাড়িতে বাড়িতে মতির মুখের বিবর্ণতা ঘুচিয়া যাইতেছিল। বারকয়েক সে জোরে জোরে নিশ্বাস গ্রহণ করিল।
কুমুদ বলিল, সঙেগ তো চললে, কোথায় থাকবে কী করবে সে সব ভেবে দেখেছ?
কুমুদের মতো বেপরোয়াভাবে মতি বলল, ওর আর ভাবব কী?
গৃহবিমুখ যাযাবর স্বামীর সঙ্গে মতিও আজ এলোমেলো পথের জীবনকে বরণ করিল-আমাদের গেঁয়ো মেয়ে মতি। হয়তো একদিন ওদের প্রেম নীড়ের আশ্রয় খুঁজিবে, হয়তো একদিন ওদের শিশুর প্রয়োজনে নীড় না বাঁধিয়া ওদের চলিবে নাজীবনযাপনের প্রচলিত নিয়মকানুন ওদের পক্ষেও অপরিহার্য হইয়া উঠিবে। আজ সে কথা কিছুই বলা যায় না। পুতুলনাচের ইতিকথায় সে কাহিনী প্রক্ষিপ্ত—ওদের কথা এখানেই শেষ হইল। যদি বলিতে হয় ভিন্ন বই লিখিয়া বলিব।
১২. হাসপাতালের নবনির্মিত গৃহটি
হাসপাতালের নবনির্মিত গৃহটি দেখিতে ভারি সুন্দর হইয়াছে। ইটের উপরে লাল-রঙ-করা ছোটখাটো ঝকঝকে সুশ্রী বাড়িখানা দেখিয়া আপসোস হয় যে একটা না দেখিয়া যাদবের মরা উচিত হয় নাই। সামনে কানিশের নিচে ইংরেজিতে বড় বড় অক্ষরে লেখা হইয়াছে—যাদব মেমোরিয়াল হস্পিটাল। তবু লোকে মুখে বলিতে বলে, শশী ডাক্তারের হাসপাতাল। যাদবকে যে লোকে ভুলিয়া গিয়াছে তা নয়। যাদবের সঙ্গে হাসপাতালের সম্পর্কটা প্রত্যক্ষগোচর হইয়া থাকে নাই,–অথচ এদিকে শশীকেই সকলে হাসপাতালটি গড়িয়া তুলিতে দেখিয়াছে এবং এখন সে-ই সমাগত রোগীদেও সযত্নে বিতরণ করিতেছে ওষুধ।
হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার হাঙ্গামা শেষ হইয়াছে, শশীর যশ ও সম্মানের বৃদ্ধি স্থগিত হয় নাই। জনসাধারণের সমবেত মনটা চিরদিন একাভিমুখী, যখন যেদিক ফেরে সেই দিকেই সবেগে ও সতেজে চলিতে আরম্ভ করে। জনরবের তিলটি যে দেখিতে দেখিতে তাল হইয়া উঠে তার কারণও তাই। লোকমুখে ছোট ঘটনা বড় হয়-মানুষও হয়। শশী অসাধারণ কাজ কিছুই করে নাই। যাদব যে কৰ্তব্যভার তার উপরে চাপাইয়া দিয়া গিয়াছিলেন সেটুকু কেবল ভালোভাবে সম্পন্ন করিয়াছে। ফলটা হইয়াছে অচিন্তিতপূর্ব। নেতার আসনে বসাইয়া সকলে তাহাকে অনেক উঁচুতে তুলিয়া দিয়াছে। কয়েকটি স্থানে বক্তৃতা করিয়া শশীর বলিবার ক্ষমতাটাও খুলিয়া গিয়াছে আশ্চর্যরকম। সভা-সমিতিতে এখন তাহাকে প্রায়ই বলিতে হয়, সকলে নিবিড় মনোযোগের সঙ্গে তার কথা শোনে। শশী আবেগের সঙ্গে কথা বলিলে সভায় আবেগের সঞ্চার হয়, হাসির কথা বলিলে আকস্মিক সমবেত হাসির শব্দে সভার আশেপাশের পশুপাখি চমকাইয়া ওঠে।
সময় সময় শশীর মনে হয় সে যে গ্রাম ছাড়িয়া চলিয়া যাইবে ঠিক করিয়াছিল সেইজন্য গ্রামের জীবন এমন অসংখ্য বাঁধনে তাহাকে বধিয়া ফেলিয়াছে। এই আকস্মিক জনপ্রিয়তা তাকে এখানে ভুলাইয়া রাখিবার জন্য। ভাগ্যে এটা পুরস্কার নয়, ঘুম। এ তো সে চায় নাই, এ ধরনের সম্মান ও প্রতিপত্তিঃ জীবনের এই গম্ভীর রূপ তাকে কিছু কিছু অভিভূত করিয়া ফেলিয়াছে সত্য, কিন্তু এ ধরনের সার্থকতা দিয়া সে কী করিবে?
একদিন সকালবেলা পরান ডাক্তারখানায় আসিয়া হাজির। শুষ্ক শীর্ণ মূর্তি, গলায় কল্ফটার জড়ানো, দেখিয়া দুঃখ হয়। দেখিয়া দুঃখ হইবার অবসর শশীর ছিল না। কত দায়িত্ব তাহার, কত কাজ। শশীর মতো ডাক্তারবন্ধু থাকিতেও এমন রোগা হইয়া গিয়াছে পরান? কী হইয়াছে পরানের? গলায় ঘা, খাইতে পারে না? সে তো অনেক দিন আগে হইয়াছিল, মতির চিঠি পাইয়া তাহাকে আনিতে কলিকাতা যাওয়ার সময়। সে ঘা এখনো শুকায় নাই? শশী আশ্চর্য হইয়া যায়, বলে যে, গলার ঘা এতদিন থাকিবার কথা নয়—সে যে ওষুধ দিয়াছিল পরান বুঝি তা ব্যবহার করে নাই? এতকাল সে ঘুমাইতেছিল নাকি?
হাসপাতালের ব্যস্ত-সমস্ত ডাক্তারের মতো ভাব শশীর,–যেন তার কাছে এসময় পরানের পর্যন্ত খাতির নাই! কথা বলিতে বলিতে সে একটা প্রেসক্রিপশন লিখিতে থাকে। রোগী যে খুব বেশি আসিয়াছে তা নয়, হাসপাতালের ভয় ভাঙিতে গ্রামের লোকের কিছু সময় লাগিবে। জন-সাতেক পুরুষ রোগী শশীর টেবিলের সামনে দাঁড়াইয়া আছে, আর দরজার বাহিরে ঘোমটা দিয়া বসিয়া আছে একটি বউ, একটি পৌঢ়া স্ত্রীলোক, বোধ হয় সে বউটির শাশুড়ি, পিঠে এক হাত আর সামনে এক হাত দিয়া আধজড়ানো ভাবে বউটিকে ধরিয়া রাখিয়াছে। সম্ভবত দুজনেই পরস্পরের কাছে খুঁজিতেছে সাহস। এই তো ক-জন রোগী, পরানকে শশী বসিতে বলারও সময় পাইল না? পরানের পায়ে জুতা নাই, শার্টে ইস্ত্রি নাই, চুলে টেরি নাই বলিয়া নয় তো? ঘরের কোনে বসিয়া মনে মনে বিশ্বজয় করিবার সময় যে ছিল বন্ধু, যার প্রতি স্মরণ করিয়া বাদলঘন উতল দুপুরে কুসুমকে সে ঘর হইতে বিদায় দিয়াছিল, একটা এতটুকু হাসপাতাল সৃষ্টি করার গৌরবে তাকেই শশী আজ এমন অবহেলা করিবে নাকি! টেবিলের এপাশে একটা চেয়ার আছে, তাতে না হোক অনেকটা তফাতে যে টুলখানা আছে তাতে পরানকে শশী বসিতে দিক।