অধিকারী বিস্মিত হইয়া বলিল, বিয়ে করেছ নাকি? বিয়ে তাহলে তুমি করলে? – কথাটা সহজে সে যেন বিশ্বাস করে না। তারপর গম্ভীর হইয়া বলিল, তাই যদি করলে বাপু, আমার মেয়েটাকে করলে না কেন? আমার মেয়ে কী দোষ করেছিল শুনি?
কুমুদ চুপ করিয়া রহিল। অধিকারী খানিকক্ষণ একটু অন্যমনা হইয়া রহিল।
অমন মেয়ে পেতে না কুমুদ। দেখেছ তো বাপু তাকে। বলো তো, তুমিই বলো, ও রকম মেয়ে সহজে মেলে? তাকে তোমার তখন মনে ধরল না! পাগল কী বলে সাধে!
অনেকক্ষণ বসিয়া অধিকারী অনেক কথা বলিল। একটা বোঝাপড়াও হইয়া গেল কুমুদের সঙ্গে। কুমুদ আবার বিনোদিনী অপেরায় যোগ দিবে। আগাম যে টাকাটা লইয়াছিল সেটা বাতিল হইয়া গেল, বিবাহের যৌতুক বলিয়া ধরিয়া নেওয়া গেল সেটা। কুমুদের সঙ্গে তো আর পারা যাইবে না, অধিকারীর সর্বনাশ না করিয়া সে ছাড়িবে কি!
দলটা আবার ভালো করে গড়ে নিতে হবে কিন্তু বাপু তোমায়, শুধু পার্ট বললে চলবে না!
কুমুদ হাসিয়া বলিল, তাই কি চলে? দল ভালো না হলে আমার পার্টও জমবে কেন?
মুখভরা হাসি লাইয়া অধিকারী সেদিন বিদায় হইল।
কুমুদ তো আবার যাত্রা করিবে, এদেশে ওদেশে ঘুরিয়া রাজপুত্র প্রবীর সাজিবে। মতির কী হইবে? সে থাকিবে কোথায়? কার কাছে? এ বড় সহজ সমস্যার কথা নয়। কিন্তু মতির কোনো ভাবনাচিন্তা আছে বলিয়া মনে হয় না। আনন্দের যে মাদকতায় সে মশগুল হইয়া আছে, ভাবনাচিস্তার ক্ষমতাও যেন তাহাতে ক্রমেই লোপ পাইয়া আসিয়াছে।
কুমুদ শেষে কথা তুলিল। বলিল, আমি এখন যাত্রা করতে যাব, তুমি কোথায় থাকবে মতি?
মতি ঘাড় কাত করিয়া বলিল, তুমিই বলো না?
গাওদিয়া যাবে?
গাওদিয়া? মতির যেন চমক লাগে। গাওদিয়ার কথা মন হইতে মুছিয়া ফেলিবার আদেশ যে দিয়াছিল, সে আবার যাচিয়া সেখানে যাওয়ার কথা বলিতেছে। কুমুদের চোখে মতি চোখ মেলায়। কী খোজে মতি কুমুদের চোখে? পলকে কুমুদ খোলস বদলায়, আজ যা বলে কাল তা বাতিল করিয়া দেয়, তবু কি তার মধ্যে এমন একটা অপরিবর্তনীয়তা থাকা সম্ভব যার মৌলিকতা মতির মতো মেয়েকেও বিহবল করিয়া দেয়।
গাওদিয়া যেতে বলছ?
তাই থাকো গিয়ে ক মাস। আমি এদিকটা একটু গুছিয়ে নি।
কী গুছাবে?
কুমুদ গম্ভীরভাবে বলে, দলটা গড়ে তুলব, টাকাপয়সা জমাব, সবই তো গুছোতে বাকি।
খুবই সুবিবেচনার কথা। তবু শুনিয়া মতির যেন কষ্ট হয়। এ ধরনের কথা কি মানায় কুমুদের মুখে? তিন মাস আগেও হয়তো কুমুদকে হিসাবি বিবেচক দেখিলে মতি খুশি হইত। এখন আর সে চায় না। তেমনি কুমুদই তার ভালো, যে বড় বড় কথা বলে, কাজের বদলে শুইয়া থাকে, ভালোবাসে তবু পা টেপায়।
কুমুদ বলে, এসে নিয়ে যাবার জন্য তোমার দাদাকে একখানা চিঠি লিখে দাও মতি।
তুমি লেখো না?
না, তুমিই লেখো।
মতি গম্ভীর মুখে বলে, তুমি তবে ঠিকানা লিখে দিও, অ্যাঁ?
মতির এই চিঠির জবাবে পরাণ ও শশী দুজনেই কলিকাতা আসিল। শশীর আগমনটা শুধু মতিকে দেখিবার জন্য, কাজ ছিল। কুমুদকে শশী অনেক কথা বলিবে ভাবিয়াছিল। কিছুই বলা হইল না। মতিকে দেখিয়া সে বাক্যহারা হইয়া গেল। এই মতি কি তার চোখের সামনে বড় হইয়াছিল গাওদিয়ার গ্রাম্য আবহাওয়ায়? এ যেন শশীর অচেনা মেয়ে, অচেনা জগতে এতকাল বাস করিয়া আজ প্রথম তার সামনে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। ফ্যালফ্যাল করিয়া হাবার মতো যে চাহিয়া থাকিত, জলে-ধোয়া আলোর মতো কী স্লিন্ধোজ্জল তার চাহনি এখন। কী ভারী চলন মতির, কী রমণীয় তার ভঙ্গিমা। মতির অঙ্গুলি-হেলনও আজ যেন মধু, অর্থময়। মনে হয়, তার দেহ-মন অহরহ করে আকর্ষণ ও আহানের জন্য প্রতিটি মুহূর্ত উদ্যত, উৎকীর্ণ হইয়া আছে।
কুমুদ একান্তে বলিল, কীরকম দেখছিস শশী মতিকে?
ওকে তুই কী করেছিস কুমুদ?
কিছুই করিনি। শুধু কথা বলেছি আর চুপ করে থেকেছি।
বিন্দুরও পরিবর্তন হইয়াছিল, এও পরিবর্তন। শশী ভাবিত হইয়া বলিল, গাওদিয়া পাঠাচ্ছিস, সেখানে থাকতে পারবে কি-না ভাবছি কুমুদ।
এ তোর কীরকম ভাবনা শুনি? গাওদিয়ায় বড় হল, সেখানে গিয়ে থাকতে পারবে না?
বিন্দুও গাওদিয়ায় বড় হইয়াছিল, সেখানে গিয়া থাকিতে পারো নাই। কিন্তু শশী আর কিছু বলিল না। সারাদিন সে বিমনা হইয়া রহিল। মতির চোখে যখন বিদ্যুৎ চমকিয়া যায় কুমুদের চোখের সঙ্গে তখন সে তুলনা করে। এ আলো তাহার চোখে নাই। কুমুদের কাছে আজ আবার নিজেকে শশীর ছোট মনে হইতে থাকে।
মতির সুখে আনন্দে উজ্জ্বল মুখচ্ছবি, মতির পুলকমন্থর গতিশ্ৰী দেখিয়া মাঝখানে কুমুদের সম্বন্ধে যতটুকু অবজ্ঞা মনে আসিয়াছিল সব যেন আজ মুছিয়া যায়। কুমুদের জীবনের যা মূলমন্ত্র তার সন্ধান শশী কখনও পায় নাই, আজ ওই বিষয়েই শশী চিত্তা করে। কী আছে কুমুদের মধ্যে দুর্বোধ্য গোপন সম্পদ, জীবনকে আগাগোড়া ফাকি দেওয়া সত্ত্বেও যাহা জীবনকে তাহার ঐশ্বর্যে ভরিয়া রাখিয়াছে?
এতকাল খবর না-দেওয়ার জন্য পরাণ ও শশীর কাছে মতি প্রথমটা একটু সংকোচ বোধ করিতেছিল, ও বিষয়ে কেহ অনুরোগ না দেওয়ায় অল্পক্ষণের মধ্যেই সে কথাটা ভুলিয়া গেল। পরাণ খুব রোগ হইয়া গিয়াছে, তাহার বিষণ্ণ শুষ্ক মুখ দেখিয়া বড় মমতা হইতে লাগিল। বারবার সে জিজ্ঞাসা করিল কী অসুখ হইয়াছে পরনের। তারপর খুঁটিয়া খুঁটিয়া গ্রামের কথা, মোক্ষদা ও কুসুমের কথাও জানিয়া লইল। একটু সলজ্জ মতি, একটু সাহসী। একজনের বউ হিসাবে দাদা ও শশীর কাছে ধরিতে গেলে এই তার প্রথম দাঁড়ানো, নিজের বাড়িতে নিজের সংসারে বাপের বাড়ির সংবাদ জানিতে একটু গৃহিণীর মতো ভাব দেখানোর অধিকারও তার ন্যায্য। ভাদ্রমাসের গরম, পাখা লইয়া মতি ওদের বাতাস করিল, তৃষ্ণায় যোগাইল শীতল জল। মতির কাজ আজ কত নিখুঁত, কত কোমল তাহার সামান্য সেবা। অনেক যত্ন করিয়া মতি আজ রান্না করিল। খাইতে বসিয়া শশী প্রশংসা করিল রান্নার, পরাণ কিন্তু একরকম কিছু খাইল না। মতি অনুযোগ দিলে বলিল, গলায় একটা ঘা হয়েছে মতি, ঝোল-তরকারি খেতে কষ্ট হয়।