অবিচলিত থাকে শুধু কুসুম। দাওয়ার নিচে খানিকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়াইয়া সে মোক্ষদার গাল শোনে।
তারপর রান্নাঘর হইতে একটা জ্বলন্ত কাঠ আনিয়া ঢুকিতে যায় শোবার ঘরে।
আঘাতের বেদনা তুলিয়া মোক্ষদা হাউমাউ করিয়া উঠে।
ও কী লো বউ, ও কী? ঘরে-দোরে আগুন দিবি না কি?
আগুন দেব কেন মা? পিলসুজের দীপটা জ্বালব।
উনুনের কাঠ এনে দীপ জ্বালাবি? দ্যাখ বুঁচি, দ্যাখ মেলেচ্ছ হারামজাদি ঘরের মধ্যে চিতা জেলে দিতে চলল, চেয়ে দ্যাখ!
কুসুম চোখ পাকাইয়া বলে, গাল দিও না বলছি অত করে, দিও না। আমপাতা দেখছ না হাতে? কাঠ থেকে যদি দীপ জ্বালাব, পাতা নিয়ে যাচ্ছি কি চিবিয়ে খাব বলে নাকি?
মোক্ষদা গলা নামাইয়া বলে, গাল তোমায় আমি দেইনি বাছা–বুঁচিকে।
কুসুমকে এ বাড়ির সকলে ভয় করে। এই বাস্তুভিটাটুকু ছাড়া হারু ঘোষের সর্বস্ব কুসুমের বাবার কাছে আজ বাধা আছে সাত বছর। একবার গিয়া কাদিয়া পড়িলেই সে দিবে নালিশ কিয়া, এরা সব তখন যাইবে কোথায়? তাই বলিয়া কুসুম যে সবসময় বাড়ির লোকগুলিকে শাসন করিয়া বেড়ায়, তা নয়। বরং সে অনেকটা নিরীহ সাজিয়াই থাকে। বকবিকি করিলে সবসময় কানেও তোলে না, নিজের মনে ঘরের কাজ করিয়া যায়। কাজ করিতে ভালো না লাগিলে খিড়কির দরজা দিয়া বাহির হইয়া গিয়া তালবনে তালপুকুরের ধারে ভূপতিত তালগাছটার গুঁড়িতে চুপচাপ বসিয়া থাকে।
উনানে ডাল-ভাত একটা কিছু চাপাইয়া হয়তো যায়। বাড়ির লোকে তাহার অনুপস্থিতি টের পায় পোড়া গন্ধে।
মেজাজের কেহ তার হদিস পায় না। কতখানি সে সহ্য করবে, কখন রাগিয়া উঠিবে, আজ পর্যন্ত তাহা ঠিকমতো বুঝিতে না পারিয়া সকলে একটু বিপদগ্রস্ত হইয়া থাকে।
পাড়ার লোক বলে, বউ তোমাদের যেন একটু পাগলাটে, না গো পরাণের মা?
মোক্ষদা বলে, একটু কেন মা, বেশ পাগল-পাগলের বংশ যে। ওর বাপ ছিল না পাগলা হয়ে, দু বছর-শেকল দিয়ে বেঁধে রাখত?
ঘরে ঢুকিয়া কুসুম প্রদীপ জ্বলিল। গাল ফুলাইয়া সবে সে শাখে তিনবার স্কু দেওয়া শেষ করিয়াছে, উঠানে শোনা গেল শশীর গলা।
বিছানার কাছে গিয়া কুসুম বলিল, সন্ধে হতে না-হতে খোঁজ নিতে এসেছে মতি।
মতি কোনো জবাব দিল না। কুসুম আবার বলিল, ওলো মতি, শুনছিস? সন্ধেদীপ জ্বালাতে-না-জ্বালাতে দেখতে এসেছে—দরদ কত?
ভারী জলচৌকিটা অবলীলাক্রমে তুলিয়া লইয়া গিয়া সে দাওয়ায় পাতিয়া দিল। বলিল, জ্বর কমেছে, ঘুমোচ্ছে এখন।
মোক্ষদা বলিল, মতি আবার ঘুমোল বো? এই মাত্তর সাড়া পেলাম যে?
শশী বলিল তোমার শাঁখের শব্দেও মতির ঘুম ভাঙল না পরাণের বউ?–সে জলচৌকিতে বসিল, ঘরের ভিতরে এক নজর চাহিয়া বলিল, পরাণ বিকেলে গিয়ে বলে এল জ্বর নাকি এবেলা খুব বেড়েছে?
কুসুম বলিল, মিথ্যে বলেছে ছোটোবাবু,–একটুতে অস্থির তো? জ্বর কই?
মোক্ষদা বলিল, কী সব বলছ তুমি আবোলতাবোল, যাও না বাছা রান্নাঘরে।
কুসুম বিনা প্রতিবাদে রান্নাঘরে চলিয়া গেল। মুখে কৌতুকের হাসি নাই, গাম্ভীর্যও নাই।
শশী বলিল, সকালে যে ওষুধ পাঠিয়েছিলাম খাওয়ানো হয়নি?
মোক্ষদা বলিল, তা তো জানি না বাবা, দেখি শুধোই মেয়েকে।
রান্নাঘর হইতে কুসুম বলিল, ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে গো হয়েছে। চেঁচামেচি করে মেয়েটার ঘুম ভাঙাচ্ছ কেন?
ঘরের ভিতর হইতে ক্ষীণকষ্ঠে মতি বলিল, আমি ওষুধ খাইনি মা।
মোক্ষদা চোখ পাকাইয়া রান্নাঘরের দিকে চাহিয়া বলিল, শুনলে বাবা, দিবি কেমন মিথ্যে কথাগুলি বলে গেল বউ, শুনলে?
শশী একটু হাসিল, কিছু বলিল না। কুসুমের এরকম সরল মিথ্যাভাষণ সে মাঝে মাঝে লক্ষ করিয়াছে। ধরা পড়িবে জানিয়া শুনিয়াই সে যেন এই মিথ্যাকথাগুলি বলে। এ যেন তাহার একধরনের পরিহাস। কালোকে সাদা বলিয়া আড়ালে সে হাসে।
ঘরে গিয়া শশী মতিকে জিজ্ঞাসা করিল, কি, কষ্ট হচ্ছে রে মতি? মতি তাহা জানে মা। সে আন্দাজে বলিল, গা ব্যথা কচ্ছে ছোটোবাবু, তেষ্টা পেয়েছে।
পিসিকে শান্তি করিয়া বুঁচি আসিয়াছিল, বলিল, আজ বড়ো কেশেছে ছোটোবাবু সারাদিন।
কানে নল লাগাইয়া শশী মতির বুকটা পরীক্ষা করিয়া দেখিল। এ পরীক্ষায় মতির বড় লজ্জা করে, বুকের মধ্যে টিপটিপ করিতে থাকে। স্টেথোস্কোপের নল বাহিয়া তাহা । শশীর কানে পৌঁছায়, সে অবাক হইয়া বলে, নিশ্বাস বন্ধ করে থাকতে তোকে কে বলেছে মতি, জোরে জোরে নিশ্বাস নে! —বুঁচি আলোটা উঁচু করিয়া ধরিয়াছে, শশী মতির মুখের দিকে তাকায়।
ভাঙা লণ্ঠনের রাঙা আলোতে মতির রঙ যেন মিশিয়া গিয়াছে।
নিঃশব্দ পদে কুসুম যে কখন পিছনে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল!
বুকে ওর হয়েছে কী? এত পরীক্ষে কিসের?
একটু সর্দি বসেছে বলে মনে হচ্ছে পরাণের বউ। গরম তেল মালিশ করে দিও।
কুসুম ভীরুকষ্ঠে বলে, সর্দি ঠিক তো ছোটোবাবু? পরীক্ষের রকম দেখে ভয়ে বুকে কাপন লেগেছে মা, ক্ষয়রোগেই বা ধরল-গুলো মতি, বলিনি তোকে? বলিনি জ্বরগায়ে হাওয়ায় গিয়ে বসিস নে, ঠাণ্ড লেগে মরবি?
শশী বাহিরে গিয়া একটু বসে। মোক্ষদা তখন সবিস্তারে তাহাকে শোনায় তাহার আছাড় খাওয়ার বৃত্তাত্ত। বলে, বউ আমাকে ঠেলে ফেলে দিয়েছে বাবা, বউ নিয়ে হয়েছে আমার মরণ।–নিচুগলায় আবোলতাবোল অনেকক্ষণ মোক্ষদা বকে। হারু আজ মরিয়াছে দিনসাতেক, তার কথা উল্লেখ করিয়া সে এখন আর সুর করিয়া কাঁদে না, বারবার শুধু চোখ করে সে কুসুমের,—শুনিয়া মনে হয় সবই বুঝে সত্য বলিতেছে। বুঁচি চুপ করিয়া শোনে, কথাটি বলে না; না দেয় সায়, না করে প্রতিবাদ। আর রান্নাঘরে শশীকে শোনাইয়া কুসুম করে যাত্রার দলের গান, টানা গুনগুনানো সুরে, অস্পষ্ট ভীরু গলায়। সত্য সত্যই পাগল নাকি কুসুম?