জয়ার জন্য ক-দিন এখানে মতির মন কেমন করিল। কতকগুলি বিষয়ে জয়ার উপরে সে নির্ভর করিতে শিখিয়াছিল। তবে জয়ার কথা বেশি ভাবিবার অবসর মতির ছিল না। পার্থিব বিচার-বিবেচনা, মানুষের সঙ্গে ঘাত-প্রতিঘাত, এসব হইয়া গিয়াছে অপ্রধান, কুমুদের কাছে ছাড়া আর সব বিষয়ে সকল দাবিদাওয়া হইয়া গিয়াছে তুচ্ছ।
এদিকে নূতন বাড়িতে আসিয়া কুমুদ আর থিয়েটারে যায় না। শুইয়া বসিয়া বই পড়িয়া সিগারেট টানিয়া দিন কাটায়। মতি একদিন কৈফিয়ত দাবি করিল, থিয়েটারে যাও না যে!
কাজ ছেড়ে দিয়েছি মতি।
কেন?
নাটক চলল না। বললে মাইনে কমিয়ে দেবে, তাই ইস্তফা দিলাম। ব্যাটারা নাটক নেবে যা-তা, না চললে দোষ দেবে অ্যাক্টরের। থিয়েটারের চেয়ে যাত্রা ঢের ভালো মতি।
মতি চোখ বড় বড় করিয়া বলিল, তোমার পাট ভালো হয় না বললে ওরা?
কথাটা তাই দাঁড়ায় বইকী। নাটক যখন চলল না, নিশ্চয় পাট বলার দোষ। নাম-করা অ্যাক্টর তো নই যে দুটো-একটা নাটক না চললেও খাতির করবে। ভালোই হয়েছে মতি, থিয়েটারে থাকতে আমার ইচ্ছে করে না।
মতি মুখখানা পাকা গিন্নির মতো করিয়া বলিল, এবার কী করবে?
কুমুদ হাসিয়া বলিল, করব, যাহোক কিছু করব! সেজন্য ভাবনা কী? দরকার হলে গয়না দেবে না দু-একটা তোমার?
মতি বলিল, নিয়ো।
অম্লান বদনে বিনাদ্বিধায় মতি একথা বলিল। আমাদের সেই গেঁয়ো মেয়ে মতি, কুমুদ চাকরি ছাড়িয়াছে শুনিয়া সে বিচলিত হইল না, গয়না দিবার কথায় মুখখানা হইল না মান। কিসে এমন পরিবর্তন আসিল মতির? কুমুদ জাদুকর বটে। খেয়ালি যাযাবর কুমুদ, মানুষকে বশ করার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে তার। জগতের নীতি রীতি নিয়মকানুন না মানুক, নিজের নিয়মগুলি সে নিষ্ঠার সঙ্গে মানিয়া চলে। তেজস্বিতা কম নয় কুমুদের, দুরন্ত তাহার চিত্তবৃত্তি। নিজের বাঁচিবার জগৎট নিজের শক্তিতে গড়িয়া তোলাও সহজ পৌরুষের কথা নয়। কুমুদের কাছে মনোবেদনা ভোলা যায়, সে ভাবে না, কাদে না, দুঃখ-দুর্দশাকে গ্রাহ্য করে না, হিসাবি সাবধানী মনেরও তার কাছে আরাম জোটে।
দিন যায়। আবির্ভাব ঘটে বর্ষার। ঘরের জানালা দিয়া, রেলিং-দেওয়া সরু বারান্দায় দাঁড়াইয়া শুধু ইটের অরণ্য চোখে পড়ে মতির, তবু তারও মধ্যে সে গাওদিয়ার ছাপ আবিষ্কার করে। দক্ষিণের দোতলা বাড়িটা ডিঙাইয়া কোনো এক বড়লোকের বাগান চোখে পড়ে, সেখানকার পামগাছগুলি যেন ইঙ্গিতে মতিকে গাওদিয়ার তালবনের কথা জানায়। নিচে গলিতে উড়িয়ার মুড়ি-মুড়কির দোকান দেখিয়া মতির মনে পড়ে গাওদিয়ার বিপিন ময়রার দোকালের কথা—গ্রাম্যবেশে অচেনা লোককে পথ দিয়া যাইতে দেখিলে গাওদিয়ার চেনা লোকের কথা মনে পড়ে। এখানকার আকাশে যে চিল বাসিয়া বেড়ায়, তাদেরও গাওদিয়ার আকাশের চিলের মতো দেখায় আকাশে মেঘ ঘনাইয়া বৃষ্টি নামা ও গাওদিয়ার চিরপরিচিত বর্ষার নিখুঁত নকল।
একদিন সত্য সত্যই মতির গহনা লইয়া কুমুদ বেচিয়া আসে। কিছুক্ষণের জন্য মতির যে একটু খারাপ লাগে না তা নয়, প্রথমবারে হারের জন্য যেরকম কান্না আসিয়াছিল সেরকম দুঃখ মতির একেবারেই হয় না। কুমুদ ফিরিয়া আসিতে আসিতে মৃদু অশাস্তিটুকুও তাহার মন হইতে মুছিয়া যায়। আবদার করিয়া বলে, গয়না বেচলে আমার, কী আননে শুনি আমার জন্যে?
কুমুদ বলে, কিছু আনিনি।
তা আনবে কেন, আনবে তো না-ই!
অভিমানে কুমুদের গলা জড়াইয়া ধরে মতি, বুকে মুখ লুকাইয়া ছলনাভরে মৃদু মৃদু হাসে। বিরাট শহরের কয়েক ফিট উর্ধ্বে এই ছোট শহরের ঘরখানায় অভিনেতা স্বামীর কণ্ঠলগ্ন মতিকে দেখিয়া কেহ চিনিবে না সে গাওদিয়ার সেই মতি। বিপজ্জনক মানুষ কুমুদ, বাঁধন কাটিয়া কাটিয়া তার এতকাল জীবন কাটিল, দায়িত্বজ্ঞানহীন নির্মম মানুষ সে, তারি পরে আজ মতির নিশ্চিন্তনির্ভর দেখিলে চমক লাগে।
তখন কুমুদ বলে, তোমার জন্যে একটা জিনিস এনেছি মতি।
কই, দাও।
কুমুদ তাহাকে পকেট হইতে সেই হার বাহির করিয়া দেয়, আজ যে গয়না বেচিতে গিয়াছিল তাও ফেরত দেয়। নাটক করিয়া করিয়া কী নাটকই কুমুদ করিতে শিখিয়াছে। সহজভবে সরলভাবে কোনো কাজ করা কুমুদের কুষ্ঠিতে লেখে না। আহ্বাদে মতির কথা জড়াইয়া যায়। এ তো শুধু গয়না পাওয়া নয়। আরও কত কী কুমুদ এইসঙ্গে তাহাকে দিয়াছে, তাহার অবোধ বালিকা বধূকে।
টাকা পেলে কোথায়?
বড়লোক বন্ধুর কাছে ধার করলাম।
মতি হি-হি করিয়া হাসে, ধার না ছাই, ফেরত যা দেবে তা জানি!
কুমুদও হাসিয়া বলে, তার ঢের টাকা আছে। না দিই না দেব ফেরত, তার কিছু এসে যাবে না তাতে।
অন্য লোক দিয়া বিনোদিনী অপেরার অধিকারীর কাছে কুমুদ একটা খবর পাঠাইয়াছিল। দুদিনের মধ্যে কুমুদের ঘরে তাহার আবির্ভাব ঘটিল। ঘরে ঢুকিয়াই বলিল, আচ্ছা লোক বটে তুমি যা হোক কুমুদ কী বলে অমন করে পালিয়ে গেলে শুনি?-একেবারেই পাত্তা নেই তোমার!
কুমুদ হাসিয়া বলিল, বসুন ঘোষমশায় বসুন। ভালো আছেন? দলটা চলছে কেমন?
খাসা চলছে। তুমি যাবার পর দলের আরও উন্নতি হয়েছে।
কুমুদ বলিল, বেশ বেশ, শুনে বড় সুখী হলাম। বড় রেগেছেন আমার পরে না?
একথার জবাবে কুমুদকেই মধ্যস্থ মানিয়া অধিকারী বলিল, রাগ হয় কিনা তুমিই ভেবে দ্যাথো। আগাম অতগুলো টাকা নিয়ে কোথায় যে পালিয়ে গেলে–
পালাব কেন ঘোষমশাই, পালাইনি। কমাসের ছুটি নিয়েছিলাম, বিয়েটিয়ে করলাম। কি-না। আজকালের মধ্যে একবার যাব ভাবছিলাম আপনার কাছে।