বুঝতে পারছি বইকী। তবে কী জানো, তোমার অনুভব করা আর আমার বোঝার। মধ্যে অনেক তফাত। কুমুদ একটু থামিল, এই, একটা কথা বলতে সাহস পাচ্ছি। হেসে উড়িয়ে দিতে পারো না?
জয়া সোজা হইয়া বসিল, তাই কি হয়? যা নিয়ে এতকাল বেঁচে ছিলাম, সব ভেঙে গেল।-চোখের পলকে জয়ার যেন ঝিম ধরিয়া যায়, মৃতের মতো দেখায় তাহাকে। তারপর সে বলিল-এটা খালি বুঝতে পারছি না, এতদিন এমন তেজের সঙ্গে কী করে নিজেকে ভোলালাম। এমন সর্বাঙ্গসুন্দর ভুল মানুষের হয় আমি তো বোকাহাবাও নই কুমুদ!
কুমুদ বলিল, কী জানো জয়া, সবাই নিজেকে ভোলায়। খিদে-তেষ্টা পেলে তা মেটানো, ঘুম পেলে ঘুমানো, এসব ছাড়া জীবনটা আমাদের বানানো, নিজেকে ভোলানোর জন্য ছাড়া বানানের কষ্ট কে স্বীকার করে? বেশিরভাগ মানুষের এটা বুঝবারও ক্ষমতা থাকে না, সারাজীবনে ভুলও কখনও ভাঙে না। বুঝতেই যদি না পারা যায়, ভুল আর তবে কিসের ভুল? কেউ কেউ টের পেয়ে যায়, তাদের হয় কষ্ট। জীবনকে যারা বুঝে, বিশ্লেষণ করে বাঁচতে চায় এইজন্য তারা বড় দুঃখী। বড় যা-কিছু আঁকড়ে ধরতে চায় দেখতে পায় তা-ই ভুয়ো। এইজন্য এই ধরনের লোকের মনে জীবন থেকে বড় কিছু প্রত্যাশা থাকা বড় খারাপ-যতবড় প্রত্যাশা থাকে ততবড় দুঃখ পায়। তুমি জানো আমি চিরদিন কীরকম খেয়ালি, দায়িত্বজ্ঞানহীন, আজ এটা ধরি কাল ওটা ধরি, জীবনটা গুছিয়ে নেবার কোনো চেষ্টা নেই, সংসারের একটুকু কাজে লাগাবার জন্যে মাথাব্যথা নেই। এরকম কেন হলাম কোনোদিন কারুকে বলিনি। অনেকদিন থেকে জানতাম। জীবনে বড়কিছু চাইতে গেলেই আমারও তোমার মতো অবস্থা হত জয়া, অনেককিছু সংগ্রহ করে দেখলাম সব ভুয়ো। তার চেয়ে যখন যা ইচ্ছে হয় তাই চাই। জোর করে কিছু চাই না- যা জোটে তাই গ্রহণ করি, কোনো প্রত্যাশা রাখি না। বড় লাভ হলে তাও অবহেলার সঙ্গে নিই। মতিকে ভালোবাসি বলছিলে, কাল যদি ওর সঙ্গে আমার চিরবিচ্ছেদ হয় দুদিনে সামলে উঠব। মতিকে দিয়ে আমি পা টেপাই জয়া।
পা টেপাও? বেশ করো। অদ্ভুত, খাপছাড়া কিছু না করলে তুমি বাঁচবে কেন? আমি যদি মতি হতাম—
অন্যকিছু করতে,-অদ্ভুত, খাপছাড়া। বাঁচার আনন্দটাই যে খাপছাড়া জয়া, খাপছাড়া কিছু না করলে—
জয়া বলিল, হ্যা। এসব জানি। আর কিন্তু বক্তৃতা দিও না কুমুদ ওবেলা বাড়ি দেখে এসে কাল তোমরা চলে যাও। চোখের সামনে তোমরা ভালবাসবে আমি সইতে পারব না।
চোখের আড়ালেও পারবে না।
সে আলাদা কথা।
বলিয়া জয়া যেন হঠাৎ আশ্চর্য হইয়া গেল।-কী ভাবলে তুমি, কী ভেবে ওকথা বললে? তুমি নিশ্চয় জানো কুমুদ, ওভাবে আমাকে তুমি কোনোদিন টানতে পারেনি? ওরকম আকর্ষণ আমার কাছে তোমার কোনোদিন ছিল না?
কুমুদ একটু অপ্রতিভ হইয়া বলিল, তা জানি। সেইরকম ইঙ্গিত করিনি জয়া। আমরা এসে তোমার ঘর ভেঙে দিয়ে গেলাম, তাই বলছিলাম চলে গেলেও আমাদের স্মৃতি তোমার অসহ্য ঠেকবে।
জয়া ক্ষীণভাবে একটু হাসিয়া বলিল, কী চমৎকার তুমি বলতে পারো কুমুদ।-ও মতি আয় ঘরে আয়। শোন যত পারিস, এসব কথা তুই বুঝবি না। আমরা একেলেধরা মানুষ কত হেঁয়ালিই করি।
আবার বাড়ি বদলের হাঙ্গামা? জয়া তাদের এখানে থাকিতে দিবে না? না দিক। ভালোই। নতুন বাড়িতে তারা সুখেই থাকিবে। রাগে মতি মুখ ভার করিয়া থাকে। কিসে কী হইল বেচারি এখনো তা বুঝিতে পারে নাই, কুমুদের ব্যাখ্যা করার পরেও নয়। জয়াকে সে শোনায়, কী অপরাধ করেছিলাম বাবা তোমার কাছে তুমিই জানো, ভালো করলে না দিদি, তাড়িয়ে দিয়ে ভালো করলে না। মনে রাখব। বলব সবাইকে।
কী বলবি?
তুমি কীরকম ভীষণ মানুষ তাই বলব। তোমার মনে এক, মুখে আর। কত ভালোবাসাই দেখাতে! গেল কোথায় সেসব? আমিও শক্ত মেয়ে আছি, নামটি যদি মুখে আনি তো মুখে যেন পোকা পড়ে।
নাম মুখে না আনলে সবাইকে বলবি কী করে?
মতি কাঁদো-কাদো হইয়া যায়। আর কথা বলে না।
বনবিহারী বিকালেই ফিরিয়া আসিয়াছিল, গম্ভীর বিষণ্ণ বনবিহারী। মতি দেখিল সকালবেলার কাণ্ডে ওদের কথাবার্তা বন্ধ হয় নাই। বনবিহারী খাওয়াদাওয়া করিল, জয়াকে কয়েকটা টাকাও দিল। তবে দুজনের মধ্যে যেন অপরিচয়ের ব্যবধান আসিয়াছে, বড় মনমরা দুজনে। মতি বলিল, থিয়েটারে যাবে না আজ? কুমুদ বলিল, না।
পরদিন সকালে গাড়ি ডাকিয়া জিনিসপত্র তোলা হইল। জয়া কেবল একবার বলিল যে দুপুরে খাওয়াদাওয়া করিয়া গেলে ভালো হইত না? বনবিহারী কিছুই বলিল না। জয়ার কাছে বিদায় না লইয়া মতি গটগট করিয়া গাড়িতে উঠিয়া বসিল। কুমুদের সঙ্গে কথা বলিতে বলিতে জয়া আসিয়া দাঁড়াইল দরজায়।
কুমুদ বলিল, আবার একদিন দেখা হবে জয়া।
জয়া বলিল, কে জানে হবে কি-না।
খবর নেব নাকি মাঝে মাঝে?
নিও। একা এসো।
মতির মনের গুমরানো আগুন দপ করিয়া জুলিয়া উঠিল। একা এসো কেন, জয়া কি ভাবিয়াছে তার সঙ্গে দেখা করিতে না আসিলে মতির মুখে ভাত ঢুকিবে না? গাড়ি ছাড়িলে সে কুমুদকে বলিল, কখনও আসতে পাররে না তুমি খবর নিতে। ও আমাদের তাড়িয়ে দিলে!
কুমুদ কিছুই বলিল না। মতি আবার বলিল, ও কেমন স্বার্থপর তা প্রথমদিনেই জেনেছি। আমরা আসবার আগে দিব্যি কেমন ভালো ঘরখানা দখল করে বসেছিল।
ওসব তুচ্ছ কথা মনে রেখো না মতি।-কুমুদ বলিল।
এক বাড়ির তিনতলায় দুখানা ঘর কুমুদ ভাড়া করিয়াছিল, আলাদা একটি রান্নাঘরও আছে। একখানার বদলে দুখানা ঘর পাওয়া উন্নতির লক্ষণ, মতি খুশি হইল।