ফেলে দাও, ফেলে দাও ও-ছবি ছুড়ে। প্রেরণা ছবি আঁকতে জানো না, তোমার আবার প্রেরণা! লজ্জা করে না প্রেরণার কথা বলতে?
জয়ার গলা রুদ্ধ হইয়া আসিল। বনবিহার রাগ চাপিতে চাপিতে বলিল, এতকাল পরে এসব বলছ যে জয়া?
এতদিন অন্ধ হয়ে ছিলাম যে, মুখেই যে তুমি বিশ্বজয় করতে পারো। বড় বড় কথা বলে ভুলিয়েছিলে আমায়–তুমি ঠক জোচ্চোর!
বনবিহারী ভীরু, একথা সহ্য করিবার মতো ভীরু নয়। সে বলিল, তা হতে পারি। এতদিন যদি অন্ধ হয়ে ছিলে, আজ দিব্যদৃষ্টি পেলে কোথায়? কে চোখ খুলে দিল শুনি? কুমুদ নাকি?
তারপরেই জয়ার বঁটিতে ক্যানভাসখানা ফালা হইয়া গেল। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হইয়া গেল। জয়া ঘরে ঢুকিয়া বন্ধ করিল দরজা। বঁটিখানা তুলিবার সময় জয়ার বোধ হয় হাত কাটিয়াছিল, কয়েক ফোঁটা তাজা রক্ত রোয়াকে পড়িয়া রহিল।
এসব কী ভীষণ দুর্বোধ্য ব্যাপার মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি জয়ার? বাকি রান্না মতি সেদিন রাঁধিতে পারল না। অনেকক্ষণ পরে জয়ার ঘরের দরজায় আস্তে আস্তে ধাক্কা দিয়া সে মৃদুস্বরে জয়াকে ডাকিল। বারকয়েক ডাকাডাকি করিতে ভিতর হইতে জয়া বলিল, যা মতি যা, বিরক্ত করিস না আমাকে।
কুমুদ ফেরা পর্যন্ত মতি চুপ করিয়া ঘরে বসিয়া রহিল। সে বড় বিপন্নবোধ করিতেছিল। এসব জটিল খাপছাড়া ব্যাপার সে বুঝিতে পারে না; স্বামী-স্ত্রীর কলহ খুবই স্বাভাবিক, কিন্তু এ কোনদেশী কলহ? জয়া যা বলিল, বনবিহারী যা বলিল, কী তার মানে? মতির মনে হইতেছিল এর মধ্যে কোথায় যেন তারও স্থান আছে, একেবারে জয়া ও বনবিহারীর মধ্যেই কলহটা সীমাবদ্ধ নয়। কী করিয়াছে সে, কী দোষ তার? কেহ যদি বলিয়া দিত মতিকে। অনেক বেলায় কুমুদ ফিরিয়া আসিল। ঘরে বসাইয়া চাপাগলায় মতি তাহাকে যতখানি পারে গুছাইয়া সব বলিল।
কুমুদ বলিল, তা হলেই সর্বনাশ মতি।
মতি ব্যাকুলভাবে বলিল, কিসের সর্বনাশ? কী হয়েছে? বলো না বুঝিয়ে আমায়? মাথাটাথা ঘুরতে লেগেছে বাবু আমার।
কুমুদ বলিল, পরে বুঝিয়ে বলল মতি, ভালো করে আমি নিজেই বুঝতে পারছি না কিছু। কী বিশ্রী গরম পড়েছে দেখছ? বাতাস করো দিকি একটু।
মতি আজ অত্যন্ত বিচলিত হইয়া পড়িয়াছিল, নতুবা বাতাস করিবার জন্য বলিতে হইত না। ঠাণ্ডা হইয়া কুমুদ স্নান করিতে গেল। খাওয়াদাওয়ার পর সটান বিছানায় চিত হইয়া আয়োজন করিল ঘুমের। মতি বলিল, দিদিকে ডাকবে না একবার?
এখন? রেগে দরজা দিয়া আছে, কে এখন ওকে ঘাটাতে যাবে বাবা। মারতে আসবে আমাকে। যাও, খেয়ে এসো।
স্নান করিয়া মতি সবে খাইতে বসিয়াছে, জয়া দরজা খুলিয়া বাহিরে আসিল। রান্নাঘরে চুকিয়া কলসি হইতে এক গেলাশ জল গড়াইয়া খাইল।
মতি ভয়ে ভলে বলিল, তোমাদের ঝগড়া হল কেন দিদি?
জয়া বলিল, তুই ছেলেমানুষের মতোই থাক না মতি!
তারপর জয়া মতির ঘরে প্রবেশ করিল। মতির আর খাওয়া হইল না। উঠিতে ভয় করে, থালার সামনে থাকাও অসম্ভব। কৌতুহল মতি দমন করিতে পারিল না। উঠিয়া গিয়া দরজার বাহিরে দাঁড়াইয়া রহিল।
জয়া বলিতেছিল, কুমুদ, এখানে তোমাদের আর থাকা হবে না। একশো টাকা মাইনে পাও, অন্য কোথাও থাকো গিয়ে, সুবিধামতো বাড়িটাড়ি আজকালের মধ্যেই দেখে নাও একটা।
কুমুদ বিছানায় উঠিয়া বসিয়াছিল, বলিল, বোসো না জয়া। বসে কী হল খুলে বলো সব।
জয়া চেয়ারটাতে বসিল, বলিল, বলাবলিতে লাভ নেই কুমুদ। তোমরা না গেলে, আমরা চলে যাব। কালের মধ্যেই যাব।
কুমুদ শান্তভাবে বলিল, বেশ তো, আমরাই উঠে যাব কাল। সেটা কিছুই কঠিন নয়।কিন্তু কী হয়েছে আমাকে না বললে সে কোনদেশী কথা হবে?
তোমাকে বলতে বাধা নেই কুমুদ না বলে পারবও না। এখনি শুনবে শোনো। বুঝবে কি-না জানি না কুমুদ। তুমি তো জানো আমি ওকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম? হঠাৎ জানতে পেরেছি তা সত্য নয়।
কিসে তা জানলে?
তোমাদের দেখে কুমুদ। তুমি তো ভালোবাস মতিকে?
কুমুদ মৃদু একটু হাসিয়াই গম্ভীর হইয়া গেল, ঠিক জানি না জয়া। খুব সম্ভব বাসি। আরও কিছুদিন পরে হয়তো সঠিক জানা যাবে।
জয়া বলিল, না, তুমিও ওকে ভালোবাস, ও-ও তোমাকে ভালোবাসে। কদিন আগে। হঠাৎ আমার সন্দেহটা হয়। আগে তো খেয়াল করিনি। তারপর কদিন তোমাদের লক্ষ করে আমি বুঝতে পেরেছি প্রেম সম্বন্ধে এতকাল আমার ধারণাই ভুল ছিল। আমি ওকে ভালোবাসিনি, ওর প্রতিভাকে ভালোবেসেছিলাম। কুমুদ, যেদিন এটা বুঝতে পারলাম সেইদিন কী দেখলাম জানো? ওর প্রতিভাও ভুয়ো-সব আমার কল্পনা।
তোমার ভুলও তো হতে পারে?
জয়ার চোখে জল আসিতেছিল; তার কষ্টের পরিমাণটা সহজেই বোঝা যায়। অল্প একটু সমানে ঝুঁকিয়া সে বলিল, আর সব বিষয়ে মানুষের ভুল হতে পারে কুমুদ, ভুলভাঙার বিষয়ে কখনও ভুল হয় না। লজ্জায় দুঃখে আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। কী করে এমন ভুল করলাম? এতকাল মিথ্যার মানস-স্বর্গ কী করে বজায় রাখলাম? কী আমার আত্মবিশ্বাস ছিল! মনে হত আমি ভিন্ন জগতে, কেউ আমার মতো ভালোবাসতে পারেনি, আমার ভালোবাসাই সত্যি, আর সকলের ছেলেখেলা। খাঁটি একজন আর্টিস্টের ব্যর্থ জীবনের সঙ্গে নিজের জীবন গেথে তার প্রতিভাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে দুঃখের তপস্যা করছি ভেবে কত আত্মপ্রসাদ ছিল, সকলের ভোঁতা সাধারণ জীবনের কথা ভেবে মনে মনে কত হেসেছি। আমার তৈরি মিথ্যা আমাকে তাই গুড়ো করে দিল। কী বলো তুমি কুমুদ, মতির কাছে মুখ দেখাতে আমার লজ্জা করছে জানি না তুমি বুঝতে পারছে কি না