তখন গেঁয়ো মেয়ে মতি জয়াকে কী একটা বুঝাইতে চাহিয়া বলে, মনটা উডু উডু করছে দিদি।
তাকেই চৈতে পাওয়া বলে।
জয়া একটু গম্ভীর হইয়া যায়। একপ্রকার নূতন দৃষ্টিতে সে যেন বিশেষ মনোযোগ সহকারে তাকায় মতির দিকে। মতি একটু অশ্বপ্তি বোধ করিয়া বলে, তোমার ক-বছর বিয়ে হয়েছে দিদি?
দু-বছর।
মোটে? অনেক বয়সে বিয়ে হয়েছে বলো?
তোর তুলনায় অনেক বইকী। চল তো মতি তোর ঘরে যাই, কটা কথা জিজ্ঞেস করব।
কুমুদ কোথায় কী ভাবে মতিকে আবিষ্কার করিয়াছিল সে কথা জানিতে জয়া কখনও কৌতুহল দেখায় নাই। আজ মতিকে খুঁটিয়া খুঁটিয়া অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিল। প্রায় সব কথাই। গভীর ও গোপন যেসব কথা কারো কাছে কোনোদিন প্রকাশ করা চলিতে পারে বলিয়া মতি ভাবিতেও পারে নাই। এতকাল পরে হঠাৎ জয়ার সমস্ত জানিবার আগ্রহ দেখিয়া মতি আশ্চর্য হইয়া গেল। সংক্ষেপে, রাখিয়া-ঢাকিয়া যে বলিবে জয়া তাও করিতে দিল না। সত্যের উপরে আরও কিছু বাড়াইয়া বলিলেই সে যেন খুশি হয়।
তারপর জয়া বলিল, তবে তো কুমুদ তোকে সত্যিই ভালোবাসে মতি?
এমন করিয়া একথা বলিবার মানে? কুমুদ তাকে ভালোবাসে না-তাই ভাবিয়াছিল নাকি জয়া? মতি সগর্বে জয়ার দিকে তাকায়। ভুল তো ভাঙিল তোমার, কুমুদের অনেকদিনের বন্ধু? আর মতির সঙ্গে চালাকি করিতে আসিও না।
কুমুদ শেষে তোকে ভালোবাসল মতি? জয়া বলে।
মতি আহত হইয়া জবাব দেয়, বাসবে না তো কী? আমি ওর কত জন্মের বউ তা জানো?
তাও জানিস মতি, জন্মে জন্মে তুই ওর বউ ছিলি? তুই অবাক করেছিস মতি। রূপ গুণ বিদ্যাবুদ্ধি নাচ গান নিয়ে কেউ যাকে বাঁধতে পারেনি তাকে তুই কাবু করলি, একফোঁটা মেয়ে? কম তো নোস তুই!
কে ওকে বাঁধতে পারেনি দিদি? সে কে? চেনো?
চিনি, তোকে বলব না।
বলো না দিদি বলো। পায়ে পড়ি বলো।
জয়া মৃদু বিপন্ন সুরে বলিল, বলে তোকে একটু কষ্ট দিতে সত্যি ইচ্ছা হচ্ছে মতি। তবু বলব না। কী করবি শুনে? তারা সব কে কোথায় ছিটকে পড়েছে, কে কী অবস্থায় আছে, কিছুই ঠিক নেই। তাছাড়া তোর ভয় কী মতি? কেউ আর পারবে না ছিনিয়ে নিতে। ফিরে গিয়েছিল, একবার চলে এসে তোর জন্যে আবার ফিরে গিয়েছিল গাওদিয়ায়!
জয়ার ভাব দেখিয়া মনে মনে বড় ভয় পায় মতি, হঠাৎ কী হইল জয়ার? কুমুদকে যারা বাধিতে পারে নাই জয়াও কী তাদের একজন নাকি? তা যদি হবে তবে তো বড় কষ্ট জয়ার মনে তাকে লইয়া কোন বুদ্ধিতে কুমুদ এখানে জয়ার সঙ্গে একত্রে বাস করিতে আসিয়াছিল? জয়ার জন্য ক্রমে ক্রমে মতির মন মমতায় ভরিয়া যায়। হিংসার চেয়ে সমবেদনাই সে বোধ করে বেশি।
কদিনের মধ্যেই মতি বুঝিতে পারে জয়ার যা হইয়াছে তা সাময়িক নয়। সে যেন স্থায়ীভাবেই মুষড়াইয়া গিয়াছে। কাজে যেন উৎসাহ পায় না, প্রতিভাবান স্বামীর সুখসুবিধা ও আরামের ব্যবস্থা করিতে সবসময় ব্যাকুল হইয়া থাকে না, ভ্ৰকুঞ্চিত করিয়া কী যেন একটা দুর্বোধ্য ব্যাপার বুঝিবার চেষ্টায় ব্যাকুল হয়। মাঝে মাঝে মতি টের পায় কুমুদ ও তার মধ্যে প্রকাশ্য কথাও ভাবের আদানপ্রদানগুলি জয়া নিবিড় মনোযোগের সঙ্গে লক্ষ করিতেছে। কী আছে জয়ার মনে? এমন তার নজর দেওয়া কেন? ভয়ে মতির বুক টিপটিপ করে।
অবসর সময়ে, কখনও কাজ ফেলিয়াও একটা বড় ক্যানভাসে বনবিহারী তুলি বুলায়। এই ক্যানভাসটিকে জয়া এতদিন গৃহদেবতার মতো যত্ন করিত, সাবধানতার সীমা ছিল না। এটি নাকি বিক্রির জন্য নয়, লোকের ফরমাশি নয়, প্রতিভার ফরমাশে প্রেরণার মুহূর্তগুলিকে বনবিহার এত রঙ দেয়; একদিন দেশবিদেশের একজিবিশনে ঘুরিয়া ঘুরিয়া এই ছবিটি চিত্রকরকে যশস্ত্রী করবে। অতসব মতি বোঝেনা। সে শুধু জানে সমস্ত ছবির মদ্ধে এই ছবিখানা বিশেষ একটা কিছু শেষ হইয়া গেলেই ছবিখানাকে উপলক্ষ করিয়া বড় বড় ব্যাপার ঘটিতে থাকিবে। দিনের-পর-দিন জয়া ও বনবিহারীকে ছবিখানার বিষয়ে সে আলোচনা শুনিয়াছে। কদিন এ আলোচনাতেও জয়ার যেন প্রবৃত্তি ছিল না। অথচ মাঝে মাঝে ঢাকা তুলিয়া তীব্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সমাপ্ত-প্রায় ছবিখানার দিকে মতি তাহাকে চাহিয়া থাকিতে দেখিয়াছে। জয়ার মত ঈষৎ স্থূলকায়া এক রমণী কঙ্কালসার এক শিশুকে ফেলিয়া ব্যাকুল আগ্রহে এক পলাতক সুন্দর দেবশিশুর দিকে হাত বাড়াইয়া আছে- ছবিখানা এই। কোথায় কী অদ্ভুত আছে ছবিটিতে মতির চোখে তো কখনও পড়ে নাই, তবে সেটা নিজের চোখের অপরাধ বলিয়া জানিয়া লইয়াছে। জয়ার কথা কে অবিশ্বাস করিবে যে এরকম ছবি পৃথিবীতে দু-চারখানার বেশি নাই?
কয়েকদিন পরে সকালবেলা এই ছবিখানাই জয়া ফ্যাসফ্যাস করিয়া ছিড়িয়া ফেলিল।
তেমন কান্ড, জয়ার তেমন মূর্তি, মতি কখনও দ্যাখে নাই। কুমুদ বাড়ি ছিল না, বেলা তখন প্রায় দশটা। মতি রান্না প্রায় শেষ করিয়া আনিয়াছিল। জয়া সকাল হইতে ভয়ানক গম্ভীর হইয়া ছিল, রাত্রে বোধ হয় স্বামীর সঙ্গে তার কলহ হইয়াছে। দু-একটা কথা বলিয়া জবাব না-পাওয়ায় কথা বলিতে মতির আর সাহস হয় নাই। কিছুক্ষণ আগে ভাত চাপাইয়া জয়া রান্নাঘরের বাহিরে গিয়াছিল। হঠাৎ জয়া ও বনবিহারীর মধ্যে তীক্ষ্ণ কথার আদানপ্রদান মতির কানে আসিল! তাড়াতাড়ি বাহির হইয়া মতি দেখিল, বিশিষ্ট ছবিখানার সামনে তুলি হাতে আরক্ত মুখে বনবিহারী দাঁড়াইয়া আছে। অদূরে জয়া। তার মুখও লাল, সে থরথর করিয়া কাঁপিতেছে।