এ নাটকের পরে যে নাটকটা হবে, তাতে।
তারপর আর মতির মনে একটুকু ব্যথা বা আপসোস থাকে না। সব কুমুদের ছল, হোটেলের ঘরে বন্ধুদের আনা, ম্যানেজারকে ঠকানো, জয়ার সঙ্গে মাখামাখি, হার বিক্রি করা, সবু কুমুদ তাকে পরীক্ষা করার জন্য করিয়াছে ওসব খেলা কুমুদের। এতদিন মজা করিতেছিল তাকে লইয়া, এবার কুমুদ তাকে ঘিরিয়া তার কল্পনার স্বর্গটি রচনা করিয়া দিবে। আলোকোজ্জ্বল স্টেজের দিকে চাহিয়া যোগেশকে মতি আর দেখিতে পায় না, দ্যাখে রাজপুত্র প্রবীরের বেশে কুমুদকে। সুখে গর্বে মন ভরিয়া ওঠে মতির। বাড়ি ফিরিয়া জয়াকে খবরটা শোনাইতে মতির তর সয় না। জয়া শুনিয়া বলে, এরকম চাকরি তো নিচ্ছে, আর ছাড়ছে, কমাস টিকে থাকে দ্যাখ। এক কাজ করিস মতি, কুমুদকে লুকিয়ে কিছু কিছু টাকা জমাস।
মনে মনে মতি তা করিতে অস্বীকার করে। লুকাইয়া টাকা জমাইবে না কচু! কী দরকার? টাকার জন্য কুমুদের যে কোনোদিনই আটকাইবে না, এখন হইতে মতির তাহাতে অক্ষুন্ন বিশ্বাস। সাজ খুলিতে খুলিতে উত্তেজনায় মতির চোখ জ্বলজ্বল করে। সে বোধ করে একটা অভূতপূর্ব বেপরোয়া ভাব,-কিসের হিসাব, ভাবনা কিসের? কে তোয়াক্কা রাখে কবে কিসে কী সুবিধা অসুবিধা হইতে পারে? কী প্রভেদ গয়না থাকায় আর না-থাকায়? কুমুদের যেমন তুলনা নাই, কুমুদের মতামতগুলিও তেমনি অতুলনীয়। মজা তারপর যা হয় হইবে। কুমুদের বুকে মতি বাপাইয়া পড়ে। আহ্বাদে গলিয়া গিয়া বলে, ওগো শোনো, নাচগান শেখাবে আমায়, আজ যেমন নাচছিল? ঘরে খিল দিয়ে তোমার সামনে নাচব?
বলে, রোজ থেঠার দেখিও, রোজ। বিকেলে বিকেলে রেধে রেখে চলে যাব, অ্যাঁ?
বলে, বেচে দেবে তো দাও না, সব গয়না, বেচে দাও। ফুর্তি করি টাকাগুলো নিয়ে।
ইশ, কী নেশা দায়িত্বহীনতার, গা-ভাসানোর কী মাদকতা এই তো সেদিন বিবাহ হইয়াছে মতির, গাওদিয়ার গেঁয়ো মেয়ে মতি, এর মধ্যে কুমুদের রোগটা তার মধ্যে সংক্রমিত হইয়া গেল? তবে, একথা সত্য যে বিবাহ বেশিদিনের না হোক সম্পর্ক কুমুদের সঙ্গে তার অনেকদিনের। তালপুকুরের ধাপে সাপের কামড় খাওয়ার দিন হইতে ভিনদেশী এই কাচপোকা গায়ের তেলাপোকাটিকে সম্মোহন করিয়া আসিতেছে।
কুমুদ খুশি হইয়া বলে, আজ তুমি যে এমন মতি?
মতি বলে,—
বিন্দে শুধায় আজকে তুমি এমন কেন রাই,
অধর কোণে দেখছি হাসি, শ্যাম তো কাছে নাই?
কুমুদ বলে, মানে কী হল?
মতি বলে, বলি গো বলি–
রাই কহিলেন, ওলো বিন্দে, চোখের মাথা খেলি!
ওই চেয়ে দ্যাখ কদমতলে আমরা গলাগলি।
কুমুদ আবার বলিল, মানে কী হল?
মানে? আনন্দের নেশায় এতটুকু গেঁয়ো মেয়ে ছড়া বলিয়াছে, তারও মানে চাই? মানে তো মতি জানে না। অপ্রতিভ হইয়া সে মুখ লুকায়।
দিন পনেরো পরে নূতন নাটক আরম্ভ হইল। পর পর তিন রাত্রি মতি অভিনয় দেখিতে গেল। জয়াকে অনেক সাধ্যসাধনা করিয়াও একদিনের জন্য কুমুদের অভিনয় দেখাইতে সে লইয়া যাইতে পারিল না। কেবল বনবিহারী জয়াকে লুকাইয়া একদিন দেখিয়া আসিল। চুপি চুপি মতির কাছে প্রশংসা করিয়া বলিল যে অ্যাক্ট করার প্রতিভা আছে কুমুদের।
অভিনয় না থাকিলে দুপুরে অথবা সন্ধ্যায় কুমুদ রিহার্সেল দিতে যায়। কুমুদ না থাকিলে রাত্রে জয়া মতির কাছে শোয়। ভোরে মতির ঘুম ভাঙে না। কুমুদ বাড়ি আসিয়া মুখের পেন্ট তুলিতে তুলিতে একবার তাকে ডাকে, তারও অনেক পরে মতি ওঠে। কুমুদকে চা করিয়া দেয় জয়াই। অনেক কিছুই করে জয়া মতির জন্য, তবু অনেক বিষয়ে পর হইয়া থাকে।
এমনই ভাবে দিন কাটিতে লাগিল মতির, ঘরের কাজ করিয়া থিয়েটার বায়স্কোপ দেখিয়া বেপরোয়া ফুর্তি ও গাওদিয়ার জন্য মনোবেদনায়, আর জয়াকে কখনও ঈর্ষা করিয়া কখনও ভালোবাসিয়া। জয়ার কাছে একটু লেখাপড়া শিখিতেও আরম্ভ করিয়াছে। যে নাটকে কুমুদ পার্ট বলে সাতদিনের চেষ্টায় সেখানা মতি পড়িয়াও ফেলিল। মনে আবার আকাশম্পর্শী আশার সঞ্চার হইয়াছে। কত কী কল্পনা করে মতি, গাওদিয়ার সেই পুরানো কল্পনার স্থানে নব নব কল্পনার আবির্ভাব ঘটিয়াছে। তাছাড়া, এতদিনে আবার যেন নূতন করিয়া কুমুদকে সে ভালোবাসিতে শুরু করিয়াছে। মনে হয়, এই যেন আসল ভালোবাসা; গাওদিয়ার তালবনের ছায়ায় শুধু ছিল খেলা, এতদিনে রোমাঞ্চকর গাঢ় প্রেমের সম্ভাবনা আসিয়াছে। মাঝখানে কী হইয়াছিল মতির? মনটা কি তার অবসন্ন হইয়া গিয়াছিল? কই কুমুদের চুম্বনে এমন অনির্বচনীয় অসহ্য পুলক তো জাগিত না,— যেন কষ্ট হইত, ভালো লাগিত না। বসন্তকালে এবার কি জীবনে প্রথম বসন্ত আসিল মতির? কুমুদ যখন বই পড়ে কাজের ফাঁকে বারবার তাহার মুখের দিকে চাহিয়া থাকিতে পাইয়াই কত সুখ হয় মতির; কুমুদ যখন বাহিরে থাকে তখন দেহে মনে অকারণে কী এক অভিনব পুলক প্রবাহ অবিরাম বহিয়া যায় শিথিল অবসন্ন ভঙ্গিতে বসিয়া থাকিতে যেমন ভালো লাগে, তেমনি ভালো লাগে চলা-ফেরা হাত-পা নাড়ার কাজ। বাসন-মাজার মধ্যেও যেন রসের সন্ধান মেলে। এই ক্ষুদ্র পৃথিবীর সমস্ত দৃশ্যে যেন সুধা ছড়ানো আছে।
জয়া বলে, কী রে, কী হয়েছে তোর? চাউনি যেন কেমন কেমন, থেকে থেকে এলিয়ে পড়িস, গদগদ কথা বলিস,-ব্যাপারখানা কী?
কী হইয়াছে মতি নিজেই কি তা জানে? মুড়ের মতো একটু মাথা নাড়ে। জয়া হাসিয়া বলে, তোকে চৈতে পেয়েছে। কাব্য লেগেছে তোর মতি।