প্রতিভা, আর্ট, শিল্পীর প্রতিষ্ঠালাভ—এসব যে কী পদার্থ, মতির তা জানা নাই, তবু জয়া ও বনবিহারীর সম্পর্কের খাপছাড়া দিকটা সে বেশ উপলব্ধি করিতে পারে। তেজ যা আছে জয়ারই আছে, স্বামীকে সে মনে করে, হইতেপারিত লাটসাহেব! নিজের ক্ষমতার পরিচয় রাখিয়াও জয়ার ভয়ে বনবিহার এতে সায় দিয়া চলে, নিপীড়িত বঞ্চিত সাজিয়া থাকে জয়ার কাছে। গরিব গৃহস্থকে স্ত্রীর কাছে রাজ্যচ্যুত রাজার অভিনয় করিতে হইলে যেমন হয় বনবিহারীরও তেমনি বিপদ হইয়াছে।
জয়া বলিয়াছিল, আমার যদি টাকা থাকত মতি! টাকার জন্যে ওকে যদি ছবি আঁকতে না হত।
টাকার জন্যই তো সবাই সব কাজ করে দিদি, করে না?
বাজে লোকে করে। যারা কবি, আর্টিস্ট, তাদের কি ও তুচ্ছদিকে নজর দিলে চলে?
মতি একটু ভাবিয়া বলিয়াছিল, টাকা জমাও না কেন? হাতে টাকা এলেই যা করে সব খরচ করো, তোমার স্বভাবও ওর মতো দিদি।
জয়া বলিয়াছিল, তুই ওসব বুঝবি না মতি। শিল্পীর মন কত কী চায়, কিছুই যোগাতে পারি না। টাকা থাকলে তবু দুদিন সচ্ছলভাবে চালাই, কোনো খোরাক তো পায় না প্রতিভার।
মতি গিয়া কখনও পিছনে দাঁড়াইয়া বিস্মিত দৃষ্টিতে বনবিহারীর ছবিআঁকা দ্যাখে। বনবিহারীর ছবিতে গাছপালা, বাড়িঘর, মানুষের পোশাক-পরিচ্ছদ সবই তার কেমন অদ্ভুত মনে হয়। টের পাইয়া বনবিহারী ফিরিয়া তাকায়। তাকায় স্নেহপূর্ণ চোখে। বলে, সময় পেলেই তোমার একখানা ছবি একে দেব খুকি!
ছবি চাই না।–মতি বলে।
কেন রাগ হলে কেন?
খুকি বলতে বারণ করিনি?
বনবিহার হাসে। বলে, যদিন তোমার খুকি না হয়, খুকি ছাড়া তোমাকে কিছুই বলব না বোন, কিচ্ছুটি নয়।
এদিকে মতির চোখে পড়ে জয়া ইশারায় ডাকিতেছে। কাছে গেলে জয়া গম্ভীর মুখে বলে, ছবি আঁকবার সময় ওঁকে বিরক্ত করিস না মতি।
মতি রাগিয়া ভাবে, ওঃ একবার হুকুম শোনো মুটকির!
একদিন মতি তাহার হারটি খুঁজিয়া পায় না। শশীর উপহার দেওয়া হার, কী হইল সেটা? আগের দিন কুমুদ দোকানে কিছু টাকা দিয়াছে, বাড়িভাড়ার টাকা দিয়াছে জয়ার হাতে। মতির তা মনে পড়ে, তবু বাক্স-প্যাটরা আনাচ-কানাচ সে পাতি-পাতি করিয়া খোজে। তালপুকুরের ধারে একদিন তার কানের মাকড়ি হারাইয়াছিল, না বলিতে কুমুদ তাহাকে কিনিয়া দিয়াছিল নূতন মাকড়ি। আজ কি সে শশীর উপহার, তার বিবাহের অলংকার, তাকে না বলিয়া আত্মসাৎ করিবে?
হার হারাইয়াছে শুনিয়া জয়া অস্বস্তিবোধ করিতে লাগিল। দুটি গরিব পরিবারের একসঙ্গে বাস করার এই একটা শ্রীহীন দিক আছে। একজনের দামি কিছু হারাইলে অন্যজনের মনে এই চিন্তাটা খচখচ করিয়া বিধিতে থাকে যে, কে জানে কার মনে কী ভাব জাগিয়াছে! এ আর কে না জানে যে দারিদ্র্য সবই সম্ভব করিতে পারে?
খোঁজ মতি, ভালো করে খোঁজ। কলতলায় পড়েনি তো? রান্নাঘরে?
মতি কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, গলায় পরিনি,তো, বাস্কয় ছিল! ও আর পাওয়া যাবে না দিদি।
কুমুদ ফিরিলে জয়াই তাহাকে খবরটা দিল। কুমুদ বলিল, হারাবে কেন? আমি বিক্রি করেছি।
সে কী কুমুদ? জয়ার চমক লাগিল।
কুমুদ বলিল, হার থেকে কী হত? টাকাটা কাজে লাগল।
মতি কাঁদিতেছিল। জয়া বলিল, টাকা কাজে লাগে, হার কি কাজে লাগে না কুমুদ?
কুমুদ বলিল, গয়না যে সব মেয়েমানুষের সর্বস্ব আমি তাদের দুচোখে দেখতে পারি না।
জয়া এবার রাগ করিয়া বলিল, মেয়েমানুষ বোলো না কুমুদ, ছেলেমানুষ বলো।
ছেলেমানুষ তো গয়না সম্বন্ধে আরও উদাসীন হবে।
জয়ার রাগ বড় আশ্চর্য। মুখে চোখে দেখা যায় না, কণ্ঠস্বরে ফুটিয়া ওঠে না, তবু টের পাওয়া যায়। সে বলিল, জগৎটা যদি তোমার মনের মতো হত, কী করে তাতে বাস করতাম ভাবি। বাড়িভাড়ার টাকা না হয় পরেই দিতে?
কুমুদ বলিল, তুমি বুঝি ভেবেছ বাড়িভাড়ার টাকা দেবার জন্যই আমি হার বিক্রি করেছি?
অনেকদিন থেকে তোমায় জানি কুমুদ, আমার কাছে হেঁইয়ালি কোরো না। জয়া আর দাঁড়াইল না। সজল চোখে মতি আজ চাহিয়া দেখিল যে জীবনে আজ প্রথম কুমুদের মুখ কালো হইয়া গিয়াছে!
তখন সকাল। সারাদিন মতি মুখভার করিয়া রহিল। কুমুদ তাহাকে একবারও ডাকিল না। বেলা পড়িয়া আসিতে মতির বুক ফুলিয়া কাঁপিয়া উঠিতে লাগিল। এ কী অবহেলা কুমুদের? গয়নার জন্য কত কষ্ট হইয়াছে তার মনে, ডাকিয়া দুটি মিষ্টি কথা পর্যন্ত সে তাকে বলিল না হয়তো হারটির জন্য এতটুকু দুঃখও আর তার থাকিত না।
সন্ধ্যার খানিক আগে কুমুদ হঠাৎ ঘর ছাড়িয়া বাহির হইয়া আসিল, কলের নিচে মাথাটা পাতিয়া দিয়া মতিকে বলিল, বেড়াতে যাবে তো, কাপড় পরে নাও।
মতি রোয়াকে তার সাধের টেবিলল্যাম্পটি সাফ করিতেছিল, কথা বলিল না। শুধু শেডটা নিচে পড়িয়া ভাঙিয়া গেল।
মাথা মুছিতে মুছিতে কুমুদ আবার বলিল, কাপড় পরে নিতে বললাম যে মতি!
মতি সজলসুরে বলিল, আমি যাব না।
চলো, থিয়েটার দেখাব।
না, বলিয়া মতি ঘরে গিয়া শুইয়া পড়িল। কিন্তু কুমুদের কাছে তাহার অভিমান টিকিবার নয়। সাজিয়া গুজিয়া কুমুদের সঙ্গে মতিতে থিয়েটারে যাইতেই হইল। সেইখানে, স্টেজে যখন মাতাল যোগেশ ‘সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল’ বলিয়া মতির বুকে কান্না ঠেলিয়া তুলিতেছে, কুমুদ তাকে খরবটা জানাইল!
এখানে চাকরি পেয়েছি মতি।
মতি মুখ ফিরাইয়া বলিল, কী বললে?
এই থিয়েটারে চাকরি পেয়েছি। একশো টাকা মাইনে দেবে।
যোগেশের সাজানো বাগানের শোক পলকে মতির কাছে মিথ্যা হইয়া গেল। সে রুদ্ধশ্বাসে বলিল, এখানে তুমি পাট করবে? কবে করবে?