আগ্রহের সঙ্গে মতি জয়া ও বনবিহারীর জীবনযাত্রা লক্ষ করে। জীবনকে ওরা এই ক্ষুদ্র গৃহাংশে আবদ্ধ করিয়াছে, বাহির হইতে কোনোরকম বৈচিত্র্য আহরণের চেষ্টা নাই। সারাদিন ছবি আঁকে বনবিহারী, শুধু ছবি বেচিবার জন্যে বাহিরে যায়, বাকি সময়ে ধরে বন্দি করিয়া রাখে নিজেকে। কখনও সচ্ছলতা আসে, কখনও অভাব দেখা দেয়।
টাকাপয়সা সম্বন্ধে বনবিহারী কুমুদের ঠিক বিপরীত। একটি পয়সা সে কখনও ধার করে না। এ বিষয়ে জয়া আরও কঠোর। দুটি পরিবার এক বাড়িতে বাস করিতেছে, কিন্তু তাদের মধ্যে আলু-পটলের বিনিময়ও জয়া বরদাপ্ত করিতে পারে না। একদিন জয়াকে বাড়িতে তরকারি দিতে গিয়া মতি যা ঘা খাইয়াছিল, কোনোদিন সে ভুলিবে না।
নষ্ট হবে, ফেলে দেব, তবু নেবে না দিদি?
না রে না। দেওয়া-নেওয়া আমি ভালোবাসি না।
আচ্ছা আচ্ছা, বেশ! আমি যদি কোনোদিন তোমার কাছে একটুকরো লেবু পর্যন্ত নেই—
কে দিচ্ছে তোকে?
রাগ হইলে মতির গ্রাম্যতা প্রকাশ পায়। সে বলিয়াছিল, তোমার বড় ছোট মন দিদি। অহংকারে ফেটে পড়ছ।
জয়া কিছু বলে নাই। একটু হাসিয়াছিল।
মতির রাগকে শুধু নয়, তাহার গ্রাম্যতা ও সংকীর্ণতাকেও জয়া হাসিয়া উপেক্ষা করে। সংকীর্ণতাও মতির এক বিষয়ে নয়। তারা আসিয়া পৌঁছিবার আগেই জয়া যে সুযোগ পাইয়া ভালো ঘরখানা যে দখল করিয়াছিল, মতির মনে সেকথা গাঁথা হয়েই আছে। সোজাসুজি কিছু না বলিলেও নিজের অজ্ঞাতে কতবার সে মনের ভাব প্রকাশ করিয়া ফেলিয়াছে। একই রান্নাঘর তাদের, পাশাপাশি উনান। মতি যেদিন ভালো মাছ-তরকারি রাধে, সেদিন রান্নাঘরের আবহাওয়া হইয়া থাকে সহজ। কিন্তু জয়া সেদিন রান্নার ঘটায় তাহাকে ছাড়াইয়া যায় সেদিন মতির অস্বস্তিও সীমা থাকে না। সে যেন ছোট হইয়া যায়। আড়চেখে আড়চোখে সে জয়ার রান্না তরকারির দিকে তাকায়, মুখখানা কালো হইয়া আসে মতির। বনবিহারী জয়াকে বড় ভালোবাসে, যত নির্বাক ও নেপথ্যে হোক সে ভালোবাসা, মতিরও বুঝিতে বাকি থাকে না। জয়ার কাছে তাই সে অন্ধকারে ইঙ্গিতে কুমুদের অসীম ভালোবাসা প্রমাণ করিতে চাহিয়া হাস্যকর অবস্থার সৃষ্টি করিয়া বসে।
জয়া নীরবে হাসে।
হাসছ যে দিদি?
হাসব না? তুই যে হাসাস।
মতি গম্ভীর হইয়া বলে, অত হাসি ভালো নয়।
জয়ার সঙ্গে খাপ খায় না মতির। মেলামেশা আছে, গল্পগুজব আরছে, প্রতি যেন তবু জমে না। আত্মীয়ার মতো ব্যবহার করিয়াও জয়া যেন অনাত্মীয়া হইয়া থাকে, ছোটবোনটির মতো তাহার প্রতি নির্ভর রাখিয়া মতি সুখ পায় না। মিলিয়া মিশিয়া যে দিনটা ভালোই কাটে, সেদিন সন্ধ্যায় মৃদু ক্ষোভের সঙ্গে মনে হয়, সবই তো আছে, ভালোবাসা কই? আসিবার সময় পথে ট্রেনে একটি বউএর সঙ্গে মতির গলায় গলায় ভাব হইয়াছিল, এও যেন তেমনি পথের পিরিতি। এত ঘনিষ্ঠতায় সমবেদনার আনন্দ কই? টাকাপয়সা এবং আরও কয়েকটি সুবিধার জন্যই কি তারা একত্র বাসা বাঁধিয়াছে, আর কোনো সম্বন্ধ গড়িয়া উঠিবে না তাদের মধ্যে? জয়ার দোষ নাই। কাঁচা মনের উচ্ছসিত আবেগে সে যা চায়, খানিক উচ্ছ্বাসভরা আদর-মমতা, জয়া কেন তা দিতে পারবে? তার শিক্ষাদীক্ষা অন্যরকম। গেঁয়ো বলিয়া অবহেলা সে মতিকে করে না, রাঁধিতে শেখায়, চুল বাঁধিয়া দেয়, সদুপদেশ শোনায়, সাস্তুনা দেয়। ভাবপ্রবণতা জয়ার নাই। মতি তাকে নিষ্ঠুর মনে করে।
তাছাড়া জয়ার মনে একটা গভীর দুঃখ আছে। স্বামীর প্রতিভা তাহার অর্থাভাবে ব্যর্থ হইতে বসিয়াছে। বিবাহ সে করিয়াছিল আর্টিস্টকে, যার ভবিষ্যৎ ছিল ভাস্বর, ঘর সে করিতেছে পটুয়ার। সমবেদনার প্রয়োজন জয়ার নিজেরও কম নয়। অথচ মতি তার এ দুঃখের স্বরূপ বোঝে না। একদিন মতিকে বলিতে গিয়া তাহার বুঝিবার শক্তির অভাবে জয়া আহত হইয়াছে। বিপুল সম্ভাবনাপূর্ব কতবড় একটা জীবন যে ঘরের পাশে পঙ্গু হইয়া আছে, মতির তাহা ধারণা করিবার ক্ষমতা পর্যন্ত নাই জানিয়া মেয়েটার প্রতি একটু বিরূপ হইয়াছে বইকী জয়ার মন!
হাসিয়া উড়াইয়া দিলেও কুমুদ ও তার সম্বন্ধে মতির ঈর্ষা ও সন্দেহটা কিছু কিছু জয়া টের পাই নায় এমন নয়।
বেপরোয়া কুমুদ যে জয়াকে কিছু কিছু ভয় করে, মতি আজকাল তাহা বুঝিতে পারিয়াছে। এখানে সে যে অনেকটা সংযত হইয়া আছে তা জয়ার জন্যই।
এমন বাঁকাভাবে মতি জয়াকে এই কথাটা শোনায় যে জয়া মনে মনে রাগ করে।
কী যে তুই বলিসা কেন, আমাকে ভয় করে চলবে কেন?
তোমাকে যেন সমীহ করে চলে দিদি।
কী করে তুই তা জানলি?
মতি সগর্বে বলে, আমি ওসব জানতে পারি দিদি, যত বোকা ভাবে অত বোকা আমি নই!
জয়া বিরক্তিভাবে বলে, তাই দেখছি।
হোটেলে বনবিহারী অল্পসময়ের জন্য যাইত, তখন তাকে মতির যেরকম মনে হইয়াছিল এখানে দেখিল সে একেবারে অন্যরকম। ভয়ানক ব্যস্ত মানুষ, সময়ের সবসময়েই অভাব। ছবি আকিতে আকিতে শ্রান্তিও কি আসে না লোকটার! তুলিটি হাতে ধরাই আছে। প্রথমে মতির মনে হইয়াছিল সে বুঝি হাসি-তামাশা খুব ভালোবাসে, হোটেলের ঘরে কীভাবেই সে হাসাইত মতিকে এখানে বনবিহারীকে তার মনে হয় একটু ভোঁতা, একটু নিস্তেজ। তার কাছে স্বামীকে জয়া একদিন যেরকম প্রতিভাবান তেজস্ব মানুষ বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে চাহিয়াছিল, বনবিহারী সেরকম একেবারেই নয়। বরং তাকে ভীরু বলা যায়। জয়াকে সে যে অন্তত খুব ভয় করে, কুমুদের চেয়ে বেশি, তাতে সন্দেহ নাই। এমন নিরীহ সাধারণ লোকটির সম্বন্ধে জয়ার ওরকম ধারণা কেন মতি বুঝিতে পারে না! খুব বড়ো কিছু করিতে পারিত বনবিহারী, দেশ-বিদেশে নাম ছড়াইত, কেবল দারিদ্র্যের জন্য পারিয়া উঠিল না,-মতির মনে হয় এই আপসোস জয়া তৈরি করিয়াছে নিজে। ছবি আঁকিয়া মানুষ নাকি আবার বড় হয়।