বাড়িঘর সাফ হয় নাই বটে, নিজের ঘরখানা জয়া কিন্তু ইতিমধ্যে গুছাইয়া ফেলিয়াছে। জিনিসপত্র নেহাত কম নয় জয়ার, তবে সবই প্রায় কমদামি। জিনিসের চেয়ে ঘরের ছবিগুলিই মতির দৃষ্টি আকর্ষণ করিল বেশি। সব ছবি হাতে আঁকা, ছোট-বড়, বাধাআবাধা, ওয়াটার কালার, অয়েল পেন্টিংপ্রভৃতি রঙবেরঙের অসংখ্য ছবিতে চারিটা দেয়াল একরকম ঢাকিয়া গিয়াছে। খুব বড় একটা ছবি দেখিয়া মতি হঠাৎ লজ্জা পায়।
জয়া খিলখিল করিয়া হাসে, বলে আমার উর্বশী-সতিন ভাই। আকাশ থেকে নামছেন কি-না, বাতাসে তাই শাড়িখানা উড়ে দিয়া পেছনের মেঘ হয়েছে। একজন সাতশো টাকা দর দিয়েছে, ও হাকে হাজার। আমি বলি দিয়ে দাও না সাতশয়েই, সাতশো টাকা কি কম, আপদ বিদেয় হোক! আসলে ওর বেচবার ইচ্ছেই নেই!
মতি বলিল, মুখখানা আপনার মতো।
তাই তো হাজার টাকা দর হাঁকে!-জয়া হাসিল।
জয়ার সাহায্যে মতি ঘর গুছাইয়া ফেলিল। সামান্য জিনিস, জয়ার ঘরের সঙ্গে তুলনা করিয়া নিজের ঘরখানা মতির খালি খালি মনে হইতে লাগিল, খেলাঘরের মতো ঠেকিতে লাগিল। কিন্তু সেই দিন বিকালেই জিনিস আসিল। কোথা হইতে টাকা পাইল কুমুদ সেই জানে, হোটেলের পাওনা ফাকি দিক, কৃপণ সে নয়। টেবিল, চেয়ার, আলনা, বড় একটা তক্তপোশ আনিয়া সে ঘর বোঝাই করিয়া ফেলিল, নীল-শেড়-দেওয়া সুন্দর একটি টেবিলল্যাম্প ও মতির জন্য ভালো একখানা শাড়িও কিনিয়া আনিল।
১১. নতুন আশার সঞ্চারে
নতুন আশার সঞ্চারে মতির মন আবার মোহে ভরিয়া যায়। চৌকিতে সে সযত্নে বিছানা পাতে; টেবিলে সাজাইয়া রাখে তাহার সামান্য প্রসাধনের উপকরণ; কাপড়-জামা কুচাইয়া গুছাইয়া রাখে আলনায়। টেবিলল্যাম্পে তেল ভরিয়া সন্ধ্যা হইতে-না-হইতেই জ্বালিয়া দেয়। বার বার সলিতাটা বাড়ায় কমায়। কতখানি বাড়াইবে ঠিক করিতে পারে না।
আর বাড়াব? না কমিয়ে দেব? একটু কমিয়েই দি, কী বলো?
কুমুদ হাসিয়া বলে, থাক না, ওই থাক।
জয়াই এবেলা রাধিয়াছে। রাত্রির খাওয়াদাওয়ার পর জয়ার জন্য ঘরে যাইতে মতির আজ প্রথম লজ্জা করিল। জয়া দাঁত মাজিতে মাজিতে বলিল, দাড়িয়ে কেন? ঘরে যাও।
তুমি আগে যাও দিদি।
কার ঘরে যাব, তোর? হাসির চোটে দাঁত মাজা হল না জয়ার। মতি অবাক মানে। কী এমন রসিকতা যে এত হাসি! তারপর মুখ ধুইয়া মতির হাত ধরিয়া জয়া তাহাকে ঘরে লইয়া গেল। বলিল, ঘরে আসতে বউ তোমার লজ্জা পাচ্ছে কুমুদ।
কুমুদ চিত হইয়া বই পড়িতেছিল। বলিল, তাই নিয়ম যে। বসো।
না যাই, ঘুম পেয়েছে, বলিয়া জয়া সেই যে চেয়ারে বসিল আর ওঠে না। বসিয়া বসিয়া গল্প করে কুমুদের সঙ্গে। কী যে সে গল্প আগামাথা কিছুই মতি বুঝিতে পারে না, থাকিয়া থাকিয়া জয়ার মুখ হইতে ইংরেজি শব্দ ছুটিয়া আসিয়া তাহাকে আঘাত করে। বন্ধু, জয়া কুমুদের বন্ধু। কুমুদ যখন রাজপুত্র প্রবীরের রূপ ধরিয়া গাওদিয়ায় উদয় হয় নাই তখন হইতে বন্ধু। ঈর্ষায় মতির ছোট বুকখানি উদ্বেলিত হইয়া ওঠে। সন্ধ্যার আনন্দের আর চিহ্ন থাকে না।
হোটেলে বন্দিজীবন ও কুমুদের বন্ধুদের আড্ডা হইতে মুক্তি পাইয়া মতি এখানে হাপ ছাড়িয়াছে, এখন শুধু গাওদিয়ার জন্য মন কেমন করে। আশায় কচি মেয়েটা বুক বাঁধিয়াছে, স্বপ্ন তো সে কম দেখিত না, সেগুলি যদি সফল হয় এবার। কিন্তু নিজেকে এখানেও সে মিশ খাওয়াইতে পারে না। আজন্মের অভ্যাস ও প্রকৃতি ওখানেও ঘা খাইয়া আহত হয়। গায়ের চেনা রূপ, চেনা মানুষগুলির কথা মনে পড়িয়া মতির চোখ ছলছল করে। কতদিন ওদের সে দেখিতে পায় নাই। সন্ধ্যার সময় পরাণ হয়তো মোক্ষদা ও কুসুমের সঙ্গে তার কথা বলাবলি করে। শশীও হয়তো কোনোদিন আসিয়া বসে। কবে কুমুদ তাহাকে গাওদিয়ায় লাইয়া যাইবে কে জানে!
মতি বলে, এখেনে তো আমরা থির হয়ে বসলাম, এবার দাদাকে একটি পত্র দাও! কত ভাবছে ওরা।
কুমুদ বলে, এর মধ্যে ভুলে গিয়েছ মতি?
কী? কী ভুলে গিয়েছি?
আমায় বলোনি গাওদিয়ার কথা ভুলে যাবে-কোনো সম্পর্ক থাকবে না গাওদিয়ার সঙ্গে? ভালো করে তোমায় আমি বুঝিয়ে দিইনি বিয়ের আগে, আমার সঙ্গে আসতে হলে জন্মের মতো আসতে হবে? চিঠি লেখালেখি চলবে না, তাও বলেছিলাম মতি।
সেই কথা। তালবনের সেই অবুঝ বিহবল ক্ষণের প্রতিজ্ঞা কুমুদ সেকথা মনে রাখিয়াছে মতির বড় ভয়। কুমুদ যা বলিয়াছিল তা-ই সে স্বীকার করিয়াছিল বটে, কিন্তু সে তো তখন বুঝিতে পারে নাই রাজপুত্র প্রবীরের সঙ্গে থাকিলেও গাওদিয়ার জন্য কোনোদিন তাহার মন কেমন করিবে। নতুন জীবন, নতুন জগৎ, পুতুলের মতো কুমুদের হাতে নড়াচড়া–এ কল্পনাতেই তার যে ভাবিবার বুঝিবার শক্তি থাকিত না। কুমুদ কি সেকথা আজ অক্ষরে অক্ষরে পালন করিবে নাকি?
মতি ক্ষীণস্বরে বলে, সে তো সত্যি নয়।
তাই বুঝি ভেবেছিলে তুমি, তামাশা করছি?
দিন কাটিয়া যায়। জীবনে আর কোনোদিন গাওদিয়ায় যাইতে পাইবে না ভাবিয়া মতির যখন কষ্ট হয় না, কাঁচা মনে তখন কম-বেশি আশা আনন্দের সঞ্চার হয়। শৃঙ্খলার যথেষ্ট অভাব থাকিলেও জীবন এখানে মোটামুটি নিয়মানুবর্তী। আর মাঝে মাঝে কুমুদকে যতই ভয়ানক, নির্মম ও পর মনে হোক, কী একটা আশ্চর্য মন্ত্রে কুমুদ তাহাকে মুগ্ধ করিয়া রাখে। একটু নির্ভর শিখিয়াছে মতি। সে জানে আবোল-তাবোল খরচ করিয়া যত নিঃস্বই কুমুদ হোক, টাকার জন্য কখনও তার আটকায় না। তা ছাড়া চারিদিকে ধার করিয়া রাখিয়া কপদকশূন্য অবস্থাতেই কুমুদ যেন সুস্থ থাকে। টাকা দিতে কামড়ায়; ঘরে টাকা থাকিলে রাত্রে যেন তার ঘুম আসে না। তা ছাড়া, আর একটা ব্যাপার মতি ক্রমে ক্রমে টের পাইয়াছে। তাহাকে ভাঙিয়া গড়িবার কল্পনাটা কুমুদ শুধু মুখেই বলিতে ভালোবাসে, কাজে কিছু করিবার তার উৎসাহ নাই জীবনে আর কিছুই কুমুদ চায় না, যখন যা খেয়াল জাগে সেটা পরিতৃপ্ত করিতে পারলেই সে খুশি। নিয়ম, দায়িত্ব, ভালোমন্দ, উচিত-অনুচিত এগুলি তার কাছে বিষের মতো। কথাসর্বস্বও বটে কুমুদ। সে যখন বড় বড় কথা বলে, সায় দিয়া যাওয়াই যে যথেষ্ট, এটুকু জানিয়াও একদিকে মতি খুব নিশ্চিন্ত হইয়াছে। তবে কুমুদের সেবা করিয়া মতি বড় শ্রান্তিবোধ করে, জ্বালাতন হয়। এক এক সময় তাহার মনে হয় যে, কুমুদের বুঝি সে বউ নয়, দাসী। সিগারেট ধরানো হইতে পা টিপিয়া দেওয়া পর্যন্ত অসংখ্য সেবা করিবে বলিয়া অত ভালোবাসিয়া কুমুদ তাহাকে বিবাহ করিয়াছে। একটু খেলা চায় মতি, নিজের একটু আরাম বিলাস। কুমুদের জ্বালায় তা জুটিবার নয়।