ম্যানেজার একদিন টাকা চাহিয়া গেল।
মতি কুমুদের বাগ ও বাক্স প্যাটরা হাতড়াইয়া দেখিয়া বলিল, মোটে সাত টাকা আছে। টাকা বুঝি লুকিয়ে রেখেছ?
কুমুদ বলিল, আর টাকা কোথায় যে লুকিয়ে রাখব?
আর নেই? মতির মুখ শুকাইয়া গেল।
কুমুদ হাসিয়া বলিল, সাত টাকা বুঝি কম হল মতি?
কী হবে তবে? কোথায় পাবে টাকা? হোটেলে টাকা দেবে কী করে? ভীত চোখে চাহিয়া থাকে মতি, বলে, রোজ তুমি জুয়া খেলে টাকা হেরে যাও, কেন খ্যালো?
তাহার দুর্ভাবনার পরিণাম দেখিয়া কুমুদের যেন মজা লাগিল। পাশে বসাইয়া বলিল, আমার বউ হয়ে তুমি তুচ্ছ টাকার জন্য ভাবছ মতি? আজ সাত টাকা আছে, আজ তো চলে যাক, কালের ভাবনা কাল ভাবব। ব্যবস্থা একটা কিছু হয়ে যাবেই মতি, টাকার জন্য কখনও মানুষের বেঁচে থাকা আটকায় না।
উতলা মতি বলল, সাত টাকায় কী করে চলবে?
দিব্যি চলবে। দ্যাখোই না কী করে চলে? চিরকাল এমনি করে চালিয়ে এলাম, আমি জানি না? তুমি কেন ভাবছ? টাকার চিন্তা করার কথা তো তোমার নয়!
মতি তবু বলিল, হোটেলের টাকা দেবে কী করে? কাল যে দেবে বললে?
আবার ভাবে ওকথা। ঘ্যানঘ্যান করার স্বভাব গড়ে তুলো না মতি, গিনির মতো মুখ কোরো না। কাল যা দেব বলেছি কাল তার ভাবনা ভাবব, আজ কেন তুমি উতলা হয়ে উঠলে?
রাত্রে বন্ধুরা ফিরিয়া গেলে একমুঠা টাকাপয়সা কুমুদ বিছানায় ছড়াইয়া দিল। বলিল, দেখলে কোথা থেকে টাকা আসে? ভেবে তো তুমি মরে যাচ্ছিলে।
মতি বিষণ্ণভাবে বলিল, কালকে হেরে যাবে আবার। কী-ই-বাহবে এ একটা টাকায়!
সিগারেট ধরাইয়া কুমুদ কিছুক্ষণ স্তব্ধভাবে মতির দিকে চাহিয়া রহিল। তারপর ধীরে ধীরে বলিল, এত অল্পবয়সে তোমার এত হিসাব হয়েছে আমি তা ভাবতে পারিনি মতি। টাকার দরকার তোমার তো এমন করে বুঝবার কথা নয়! ছেলেমানুষ তুমি, নিজের ফুর্তিতে থাকবে, কিসে কী হবে না হবে সে ভাবনা ভাবতে তোমার হবে বিরক্তি। তা নয়, টাকা কম পড়েছে বলে সারাদিন মুখ কালি হয়ে রইল। এত কচি ছিলে গাওদিয়ায়, এত পাকলে কখন? কিছুই যে সেখানে তুমি বুঝতে না মতি, যা বলতাম শিশুর মতো মেনে নিতে আর হা করে তাকিয়ে থাকতে মুখের দিকে? ঠকিয়েছিলে নাকি আমায়, ছেলেমানুষির ভান করে?
মতি জবাব দিতে পারে না, কুমুদের অভিযোগ ভালো করিয়া বুঝিতেও পারে না, তার শুধু কান্না আসে। ছেলেমানুষির ভান করিত? সে কি এখনো ছেলেমানুষ নয়? টাকা নাই তাই টাকার কথা ভাবিয়াছে, তাতেই কি মানুষের ছেলেমানুষি ঘুচিয়া যায়? পরদিন টাকা চাহিতে আসিয়া ম্যানেজার খালি হাতে ঘুরিয়া গেল। টাকা থাকিতেও কুমুদ তাকে টাকা দিল না কেন মতি বুঝিতে পারিল না, ভয়ে কিছু বলিল না।
দিন সাতেক পরে সকালবেলায় কুমুদ একটা অল্পদামি টিনের তোরঙ্গ কিনিয়া আনিল। মতিকে বলিল, জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও মতি, বাড়ি ঠিক করে এলাম, খেয়েদেয়ে বাড়িতে গিয়ে উঠব। এ শালার হোটেলে আর মন টিকছে না।
সদ্য-ক্রীত টিনের তোরঙ্গটিতে কিছুই ভরা হইল না। কুমুদ বলিল, ওটা খালি থাক মতি। বাকি জিনিস সমস্ত বাঁধিয়া-ছাদিয়া গুছাইয়া নেওয়া হইল। কেবল একটি ফরসা চাদর পাতা রহিল চৌকির উপরে, একটা বালিশও রহিল। আলনায় ঝুলানো রহিল ছেড়া একটা পাঞ্জাবি, একখানা পুরোনো কাপড় ও একটা গেঞ্জি। তারপর কুমুদ চাকরকে পাঠাইয়া দিল গাড়ি ডাকিতে।
খবর পাইয়া ম্যানেজার ছুটিয়া আসিল। বলিল, চললেন নাকি কুমুদবাবু?
কুমুদ বলিল, স্ত্রীকে রেখে আসতে যাচ্ছি বাপের বাড়ি, কাল ফিরব বিকেলের দিকে। জিনিসপত্র রইল, একটু নজর রাখবেন ঘরটার দিকে।
ম্যানেজার বলিল, টাকা দেবেন বলেছিলেন আজ?
কাল দেব। কাল নিশ্চয় পাবেন।
আশেপাশেই রহিল ম্যানেজার। গাড়ি আসিলে এবং জিনিসপত্র তোলা হইলে কুমুদ ঘরে তালা বন্ধ করিল। ঘরের মধ্যে নতুন তোরঙ্গ, চৌকির বিছানা ও আলনার জামাকাপড় দেখিয়া ম্যানেজার একটু আশ্বস্ত হইল।
গাড়িতে উঠিয়া মতির মুখে কথা সরে না। কুমুদ মৃদু হাসে। বলে, ভাবছ ম্যানেজারকে ঠকালাম? টাকা দিয়ে যাব মতি।
কাল আসবে?
কাল কি আর আসব, হাতে টাকা হলেই আসব। মিছামিছি গোলমাল করত টাকার জন্যে, তাই একটু কৌশল করলাম, নইলে কাউকে আমি ঠকাই না মতি, দু-চার মাসের মধ্যে টাকাটা একদিন ঠিক দিয়ে যাব।
ঘরঘর শব্দে গাড়ি চলে। কোথায় যাইতেছে তারা? আকাশ-পাতাল ভাবে মতি, কুমুদের কাছে থাকিয়া তার যেন বিপদের ভয় হয়, কুমুদ যেন ভয়ানক মানুষ। অনেকক্ষণ চলিয়া সরু একটা গলির মধ্যে ছোট একতলা একটা বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড়াইল। একটু পরেই দরজা খুলিল বনবিহারী, জয়াও আসিয়া দাঁড়াইল। বলিল, মঙ্গলঘট স্থাপনের সময় পাইনি, বাড়িতে শাঁখ নেই, উলু দিতেও জানি না,-মাপ কোরো কুমুদ।
ছোট বাড়ি, পাশাপাশি দুখানা শয়নঘর, সামনে একরত্তি একটু রোয়াক ও ছোট উঠান, একপাশে রান্নাঘর এবং তার লাগাও পায়রার খোপের মতো একটি বাড়তি ঘর। উঠানে দাঁড়াইয়া মতিকে এদিক-ওদিক চাহিতে দেখিয়া জয়া বলিল, বাড়ি বুবি তোমার পছন্দ হচ্ছে না?
মতি দ্বিধাভাবে বলিল, মন্দ কী?
জয়া বলিল, যে তাড়াহুড়ো করে এলাম কাল বিকেলে ঘরদের এখনো সাফ পর্যন্ত করা হয়নি। যাক, দুজনে হাত চালালে সব ঠিক করে নিতেই আর কতক্ষণ। আমি এ ঘরখানা নিয়েছি, এ ঘরে জানালা বেশি আছে একটা, মোটা মানুষ একটু আলো-বাতাস নইলে হাপিয়ে উঠি। তোমার ঘরখানা একটু ছোট হল। তা হোক! তুমি মানুষটাও ছোট, নতুন সংসারে জিনিসপত্রও তোমার কম, এতেই তোমার কুলিয়ে যাবে।