বন্ধুরা চলিয়া গেলে কুমুদ বলে, আগে বিছানা পাতবে? নামিয়ে দেব চৌকিটা? না, খেয়ে নেবে আগে?
মতি সাড়া দেয় না! উঠিয়া কাছে যাইবে তাতেও কুমুদের আলস্য। বলে, শোনো, শুনে যাও। রাগ হল নাকি? আহা, শোনোই না।
বেশিক্ষণ অবাধ্য হওয়ার সাহস মতির হয় না। কাছে গিয়া কাঁদিতে থাকে, বলে, এত লোক ঘরে এলে আমি কেমন করে থাকি?
কুমুদ তাকে আদর করিয়া বলে, বন্ধুরা এলে কি তাড়িয়ে দিতে পারি মতি? ওরা তো জ্বালাতন করে না তোমাকে?
তখন মতি বলে যে কুমুদ তবে আর একটা ঘর ভাড়া নিক। কুমুদ বলে, ঘরের ভাড়া কি সহজ, অত টাকা কোথায়? মতি তখন জবাব দেয় টাকার যখন এমন অভাব, খুব সস্তায় ছোটখাটো একটা বাড়ি ভাড়া নিলেই হয়। এখানে আর ভালো লাগিতেছে না মতির। আর তাও যদি না হয় বন্ধুদের কারো বাড়ি গিয়া কুমুদ আড্ডা বসাক।
এত রাত পর্যন্ত তোমায় একা রেখে যাব? ভয় করবে না তোমার?
না ভয় করবে না। ঘরে খিল দিয়ে থাকব।
এবার আর কুমুদ এমন যুক্তি দেখায় না মতি যা খণ্ডন করিতে পারে। প্রথমেই মতিকে এমন সোহাগ করে যে সে অবশ, মন্ত্ৰমুগ্ধ হইয়া আসে। তারপর সে মতিকে বোঝায় বলে, ভেঙেচুরে গড়ে নেব বলিনি তোমাকে? বলিনি ঘর সংসার পেতে বসবার আশা কোরো না? সে তো সবাই করে, রাস্তায় মুটে থেকে মহারাজ পর্যন্ত। আমি তো সেইরকম নই মতি। নিয়ম মেনে চলতে হলে দুদিনে আমি মুষড়ে মরে যাব। ভেসে ভেসে বেড়াই, কাল কী হবে ভাবি না, যা ভালো লাগে তাই করি। আমার সঙ্গে থাকতে হলে কনেবউটি সেজে থাকলে চলবে কেন তোমার? বউ-মানুষ আমি, আমি এমন করে থাকব অমন করে থাকব,-এ ভাব যদি তোমার মনের মধ্যে থাকে, আমার সঙ্গে তোমার তবে বনবে না। আমি রোজগার করে আনব আর ঘরের কোণে বসে তুমি রাধবে, বাড়বে, ছেলেমেয়ে মানুষ করবে,-কবে তো বলেছি তোমাকে, তা হবার নয়। বউ তুমি নও, তুমি সাথি। অন্তত তাই তোমাকে হতে হবে। তোমার সম্বন্ধে সব বিষয়ে আমার যদি দায়িত্ব নিতে হয়, তুমি যদি ভার হয়ে থাকো আমার, তোমাকে না হলে আমার একটুও ভালো লাগবে না মতি। তোমার জন্য যদি আমাকে বদলে যেতে হয়, যেভাবে দিন কাটাতে চাই তা না পারি, কী করে তোমাকে তাহলে রাখব আমার সঙ্গে?
মতি সভয়ে বলে, ত্যাগ করবে আমাকে?
কুমুদ হাসিয়া তাহার গায়ে মাথায় হাত বুলায়, বলে, ভয় পেয়ো না, সব ঠিক হয়ে যাবে মতি। ভাবনার কী আছে? এক বচ্ছর আমার সঙ্গে থাকলে এমন বদলে যাবে যে, আমাকে আর বলে দিতে হবে না, যেখানে যে অবস্থাতে থাকো তাতেই মজা পাবে। অভ্যাস নেই কি না, তাই প্রথমটা অসুবিধা হচ্ছে। দুদিন পরে আর গ্রাহ্যও করবে না। তখন কী করব জানো? ওদের আসতে বারণ করে দেব।
কেন?
বেশিদিন আমার কিছু ভালো লাগে না মতি। অনেকদিন পরে কলকাতা এলাম, তাই একটু আড্ডা দিচ্ছি বিতৃষ্ণা জন্মাল বলে।
দিনদুই পরে বনবিহার একেবারে সস্ত্রীক আসিয়া হাজির হইল। জয়া একটু মোটা, তবে সুন্দরী। টকটকে রঙ, মুখখানা গোল, জমকালো চেহারা। চোখদুটি ঝকঝকে, ধারালো দৃষ্টি।
তুমি তো গেলে না, আমি ভাই তোমাকে তাই দেখতে এলাম। তোমার ব্যাপারটা কী কুমুদ? বিয়ে করে বউকে লুকিয়ে রাখলে? ওকে তো অন্তত পাঠালাম সাতবার, তবু কি একবার মনে পড়ল না জয়া বলে একটা জীব কৌতুহলে ফেটে পড়ছে? গা থেকে বউ এনেছ শুনে অবধি অবাক মেনেছি।
ধারালো চোখে জয়া মতিকে দেখিতে থাকে। বলে, কচি বলে কচি, এ যে ধাঁধা লাগানো কুমুদ আমার মেয়ে হলে ওকে যে ফ্রক পরিয়ে রাখতাম!–তাকায় দ্যাখো কেমন করে। এসো তো ভাই খুকি এদিকে, নেড়েচেড়ে দেখি।
বাজিয়ে দেখবে না? বনবিহারী বলিল।
কুমুদ বলিল, স্পিড একটু কমাও জয়া, ভড়কে যাবে। পুতুল তো নয়।
জয়া হাসিল, মায়া নাকি? শেষে মায়া করতেও শিখলে মতির দিকে চাহিয়া বলিল, এসো এদিকে, এখানে বোসো। প্রেজেন্ট কিন্তু আনিনি ভাই তোমার জন্যে, টাকায় কুলোল না। পরে কিনে দেব। খালি হাতেই ভাব করে যাই আজ।
সাধারণ একখানা শাড়ি পরনে, যেন দাসীর বেশ জয়ার বেশভূষা, কথাবার্তা ভাবভঙ্গি মতির কাছে অদ্ভুত ঠেকিতে লাগিল। কুমুদের নাম ধরিয়া ডাকে গুরুজনের মতো, অথচ কথা ফাজলামি করিয়া, এ কোনো-দেশী মেয়েমানুষ? প্রথম দেখাতেই জয়ার সম্বন্ধে মতির মনে একটা বিরুদ্ধভাবের সৃষ্টি হইয়া রহিল। কেমন একটা অদ্ভুত অনুকম্পার ভাব জয়ার, মতিকে দেখিয়া তার যেন হাস্যকর মনে হইতেছিল! ঘণ্টাখানেক বসিয়া জয়া চলিয়া গেল।
মতির মনে হইল, ঘরে যেন একঘণ্টা ধরিয়া ম্যাজিক হইতেছিল,–ভোজবাজি কী বলিল জয়া, কেন হাসিল, অর্ধেক সময় মতি তা বুঝিতেই পারে নাই, শুধু কুমুদ ও জয়ার মধ্যে যে নিবিড় অন্তরঙ্গতা আছে এটা টের পাইয়া বোধ করিয়াছে ঈর্ষা।
নাম ধরে ডাকলে যে তোমায়?
মতির প্রশ্নে কুমুদ কৌতুক বোধ করিলা আমার বন্ধু যে মতি, অনেক দিনের বন্ধু।
মতি অবাক। মেয়েমানুষ বন্ধু। খানিকক্ষণ স্তন্ধ থাকিয়া বলিল, আচ্ছা, ও যে তোমার সঙ্গে ওরকম করছিল, ওর স্বামী রাগ করবে না?
কীরকম করছিল? কুমুদ জিজ্ঞাসা করিল।
মতি কথা বলিল না।
কুমুদ বলিল, তোমার মন তো বড় ছোট মতি।
একটু পরে মতির চোখ দিয়া জল পড়িতেছে দেখিয়া হঠাৎ পাঞ্জাবি গায়ে দিয়া কুমুদ বাহির হইয়া গেল। বলিয়া গেল, ছিঁচকাদুনেও নও কম।
কুমুদের কছে এমন কঠিন কথা মতি আর শোনে নাই। স্বামীর প্রথম ভর্ৎসনায় মতির চোখের জল শুকাইয়া গেল।