সকলে এরকম নয়। মতির সঙ্গে আলাপ করিবার চেষ্টাও কেউ কেউ করে। কেউ ঘরে ঢুকিয়াই একেবারে বহুদিনের পরিচিত হইয়া উঠিতে চায়, কেউ ধীরে ধীরে পরিচয় গড়িয়া তুলিতে চেষ্টা করে,-কারো কথাবার্ত হয় কৃত্রিম, কারো সহজ ও সরল। বইটই দু-একটা উপহারও মতি পায়। এইসব বন্ধুদের মধ্যে একজনেক মতির বড় ভালো লাগিল, মোটা জোরালো চেহারা আর শক্ত কালো একঝাড় গোপ থাকা সত্ত্বেও। তার নাম বনবিহারী।
জাকিয়া বসিয়া প্রথমেই সে ঠাট্টা করিয়া বলিল, খুকি বলব, না বউদি বলব?
মতি বলিল, খুকি কেন বলবেন?
বনবিহারী যেন অবাক হইয়া গেল। কুমুদকে বলিল, কই রে, তেমন গেঁয়ো তো নয়। কথা বলার জন্যে সাধাসাধি করতে হল কই?
কুমুদ বলিল, লজ্জা একটু ভেঙেছে।
আরও কত কী ভাঙবে।—বলিয়া বনবিহারী হাসিল। মতিকে বলিল, অনেক দিনের বন্ধু আমি কুমুদের। বয়সের হিসাব ধরলে আমি তোমার ভাসুর হব, কিন্তু বয়সের কথাটা মনে রাখতে বউ আমাকে বারণ করেছে।
মতির লজ্জাও করে, হাসিও আসে।
বনবিহারী বলিল, তোমাকে হোটেলে এনে তুলেছে শুনে মাথাটা কাটিয়ে দিতে এসেছিলাম। আমার স্ত্রীও এই ইচ্ছা অনুমোদন করেছেন। এখন তোমার অনুমতি পেলেই কাজটা করে ফেলতে পারি। দেব নাকি মাথাটা ফাটিয়ে?
কৌতুকে মতির চোখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। বনবিহারী বলিল, বিজ্ঞাপনের ছবি একে পেট চালাই, বাড়ি বলতে একটা ঘর আর একফোঁটা একটু বারান্দা। তবু সেটা বাড়ি, হোটেল তো নয়। এ রাস্কেলের তাও খেয়াল থাকে না।
অসময়ে আসিয়া বনবিহারী অনেকক্ষণ বসিয়া গেল। আগাগোড়া কত হাসির কথাই যে সে বলিল! শেষের দিকে চাপিয়া রাখিতে না পারিয়া মতি মাঝে মাঝে শব্দ করিয়াই হাসিয়া উঠিতে লাগিল। কুমুদকে একদিন সন্ত্রীক তার বাড়িতে যাওয়ার হুকুম দিয়া বনবিহার সেদিন বিদায় হইল।
কুমুদ বলিল, হালকা লোক, ফাঁপা। পয়সার জন্য আর্টকে জবাই করছে। ছবি আঁকার অদ্ভুত প্রতিভা ছিল, নাম হওয়া পর্যন্ত লড়াই করিতে পারল না। মাসিকের পট বিজ্ঞাপনের ছবি একে দিন কাটায়। সেজন্য আপসোসও নেই, এমন অপদার্থ।
বনবিহারীর অপরাধটা মতি বুঝিতে পারে না। বুঝিতে ইচ্ছা হয় না। কথার অন্তরালে স্নেহ ছিল বনবিহারীর, সমবেদনা ছিল। গ্রাম ছাড়িয়া আত্মীয়পরিজনের সঙ্গ ছাড়িয়া ছেলেমানুষ সে যে একটা অপরিচিত অদ্ভুত জগতে আসিয়া পড়িয়ছে, বনবিহারী ছাড়া কুমুদের আর কোনো বন্ধু বোধহয় তাহার খেয়ালও করে নাই। দুদিন পরে সকালবেলা বনবিহারী আবার আসিল। না-যাওয়ার অন্য অনেক অনুযোগ দিয়া বলিল, চলো কুমুদ, এখুনি যাই আজ, ওখানেই খাওয়াদাওয়া করবি।
কুমুদ হাই তুলিয়া বলিল, যাব যাব, এত ব্যস্ত কেন?
বনবিহারীর মুখখানা এবার একটু গম্ভীর দেখাইল। সুর ভারী করিয়া সে বলিল, তোর ব্যাপারটা কী বল তো কুমুদ? আমাদের ওদিকে যাস না আজ ছ মাস, যেতে বলায় আজ হাই উঠছে? সাতদিন তোর দেখা না পেলে আগে আমাদের ভাবনা হত। হঠাৎ যে ত্যাগ করলি আমাদের?
ত্যাগ? ত্যাগের স্বভাব আমার নেই। এমনি হাই উঠছে–শ্রান্তিতে।
সারাদিন শুয়ে থেকে শ্রান্তি! আর যেতে বলব না কুমুদ।
কী দরকার? কাল-পরশুর মধ্যে একদিন হশ করে হাজির হব দেখিস।
বনবিহার এবার হাসিল, হয়তো তার আগেই জয়া হশ কওে এসে হাজির হবে এখানে। কী শাস্তিটা তখন যে তোকে দেবে ভেবে পাচ্ছি না। খুকিকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়ে একমাস হয়তো লুকিয়ে রেখে দেবে।
বনবিহারীর মুখে খুকি শব্দটা মতির ভালোই লাগে। তবু সে আবদার করিয়া বলিল, আবার খুকি কেন?
বনবিহারী চলিয়া গেলে কুমুদকে বলিল, চলো না যাই একদিন? অমন করে বলছেন!
কুমুদ মৃদু হাসিয়া বলিল, উনি কি আর বলছেন মতি, ওর মুখ দিয়া আর একজন বলাচ্ছেন তার নাম জয়া, উনার তিনি পত্নী।–যাব, ইতিমধ্যে একদিন যাব।
এদিকে ক্রমে ক্রমে সন্ধ্যাবেলা কুমুদের সমাগত বন্ধুর সংখ্যা বাড়িতে থাকে, রীতিমতো আড্ডা বসে। চৌকিতে কুলায় না। চৌকি কাত করিয়া রাখিয়া মেঝেতে বিছানা ও চাদর বিছাইয়া সকলে বসে। কেহ অনর্গল কথা বলে, কেহ থাকিয়া থাকিয়া প্রবল শব্দ করিয়া হাসে, কেহ গুনগুন করিয়া ভাঁজে গানের সুর। দেয়ালে ঠেস দিযা শুরু হইতে শেষ পর্যন্ত কেহ শুধু ঝিমায়। বিড়ি, সিগারেট আর চুরুটের ধোঁয়ায় ঘরের বাতাস ভারী হইয়া ওঠে।
তাস খেলা হয়। টাকা পয়সার আদান-প্রদান দেখিয়া মতি বুঝিতে পারে জুয়া খেলা হইতেছে।
মতির কান্না আসে। সহজভাবে সে নিশ্বাস ফেলিতে পারে না। লজ্জা করিতে কুমুদ তাহাকে বারণ করিয়াছে, কুমুদের বন্ধুরা একজন দুজন করিয়া আসিলে মতির বেশি লজ্জা করেও না। এ তো তা নয়। যে ঘর ছাড়িয়া এক মিনিটের জন্য তাহার বাহিরে যাওয়ার উপায় নাই, একপাল বন্ধু জুটাইয়া সে ঘরে কুমুদ সন্ধ্যা হইতে রাত এগারোটা পর্যন্ত আড্ডা দেয়, হাজার লজ্জা না করিলেও যে চলে না।
মতি চা যোগায়। বিকালে স্টোভ ধরায়, রাত বারোটার আগে সে স্টোভ ঠাণ্ড হইবার সময় পায় না। বোধহয় কুমুদের বলা আছে, সন্ধ্যার বন্ধুরা মতিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে, চা পান প্রভৃতির প্রয়োজন পর্যন্ত কুমুদকে জানায়। চা করিয়া, পান সাজিয়াই মতির কর্তব্য শেষ, বিতরণ করিতে হয় না। এদিকের জানালায় গিয়া সে বসিয়া থাকে সমস্তক্ষণ। জানালার পাটগুলি ঘরের ভিতরে খোলে, তারই আড়ালে মতি একটু অন্তরাল পায়। ওইখানে মাঝে মাঝে মতির রোমাঞ্চ হয়। ভয়ে সে কাঁদিতেও পারে না, ঘরে এতগুলি মানুষ। রাগে দুঃখে অভিমানে পাখি হইয়া মতির গাওদিয়া উড়িয়া যাইতে সাধ হয়। ক্রমে রাত্রি বাড়ে। রাস্তার লোক চলাচল কমিয়া আসে, সরু গলিটার ওমাথায় ক্ষণিকের জন্য আলোকিত ট্রামগুলিকে আর যাইতে দেখা যায় না, তীব্র আলো নিভাইয়া পথের ও পাশের মনোহারি দোকানটি বন্ধ করা হয় ন আর দোকানটির ঠিক উপরের ঘরে মতিরই সমবয়সি একটি মেয়ে টেবিল চেয়ারে পড়া সাঙ্গ করিয়া শয়নের আয়োজন করে। দেখিয়া মতিরও ঘুম আসে।