কুমুদকে ব্যাপারটা বলিবার সময় মতির ভয় করিতে লাগিল যে, শুনিয়া হয়তো সে রাগিয়া অনর্থ করবে, খুন করিয়াই ফেলিতে চাহিবে সেই দুৰ্বত্ত ছেলেটাকে। কুমুদ কিন্তু শুধু একটু হাসিল। বলিল, ছেলেটা তো চালাক কম নয়!
চালাক পাজি নয়, শয়তান, নয়, লক্ষ্মীছাড়া নয়, শুধু চালাক?
এমন ভয় করছিল আমার! মতি বলিল।
কুমুদ বলিল, কিসের ভয়? খেয়ে তো ফেলত না। এত লোক রয়েছে চারিদিকে, ছল করে তোমার সঙ্গে কথা বলে যাওয়ার বেশি সাহস কী আর হত ছোড়ার। হয়তো কার সঙ্গে বাজি-টাজি রেখেছিল, তোমার সঙ্গে কথা বলবে। অল্পবয়সের পাগলামি ওসব।
হয়তো তাই, তবু কুমুদ কেন তাহা বরদাস্ত করিবে? মনে মনে মতি বড় ক্ষুন্ন হইয়া গেল। শশী হইলে হয়তো এরকম হাসিয়া উড়াইয়া দিত না ব্যাপারটা, ছড়ি হাতে ছোঁড়াটাকে ঘা-কতক বসাইয়া দিয়া আসিত। মতির হঠাৎ মনে হয় কুমুদের এ যেন ভীরুতা। ব্যাপারটা সে হালকা করিয়া চাপা দিতে চায়, তার কারণ আর কিছুই নয়, যদি গুরুতর হইয়া ওঠে, যদি তার কোনো অসুবিধা বা ক্ষতি হয়, কুমুদের এই আশঙ্কা আছে। ছোট ছোট অপমান কি কুমুদ তবে হাঙ্গামার ভয়ে গ্রাহ্য করে না? এ বিষয়ে সে কি গাওদিয়ার কীর্তি নিয়োগীর মতো?
মতির জন্য কুমুদ একজোড়া জুতা কিনিয়া আনিয়াছিল। বিবাহের পর মতিকে এই তার প্রথম উপহার।
একে একে এই হোটেলেই সাতদিন কাটিয়া গেল! এর মধ্যে মতিকে কুমুদ একদিন দেখাইল সিনেমা আর একদিন লইয়া গেল গঙ্গাতীরে বেড়াইতে। কত কী সে বলিয়াছিল। ঘুরিয়া ঘুরিয়া শহর দেখাইবে, আজ সিনেমা, কাল থিয়েটার করিয়া বেড়াইবে, গৃহকোণে মুখোমুখি বসিয়া থাকিবে কপোত-কপোতীর মতো। সেসব সংকল্প কোথায় গেল কুমুদের? তার অপরিমেয় আলস্যপ্রিয়তায় মতি অবাক হইয়া থাকে। কোথাও লইয়া যাওয়া দূরে থাক, মতির সঙ্গে খেলা করিতেও তার যেন পরিশ্রম হয়, অমন কোমল হালকা দেহ মতির, তবু কুমুদের বুকে তার এতটুকু ক্ষণস্থায়ী আশ্রয়! শুইয়া বসিয়া হাই তুলিয়া বই পড়ে কুমুদ, আলস্যের মধুর আরামে দিনে একটিন সিগারেট খায়, বা করিয়া মতিকে খানিক আদর করিয়া জানালা দিয়া পুরা দশ মিনিট চাহিয়া থাকে বাহিরে, অন্যমনে শিস দেয়। বলে, চা করো মতি।
মতি বলে, কোথাও নিয়ে যাবে না আমাকে আজ?
কুমুদ বলে, কোথায় যাবে? কী আর দেখবার আছে কলকাতায়? একদিন থিয়েটার দেখো, ব্যস, তাতেই অরুচি। তারপর চলো না একদিন বেরিয়ে পড়ি, পুরী ওয়ালটেয়ার সব বেড়িয়ে আসি? এখানে অদ্রলোক থাকে? কলকাতা কি শহর, এ তো একটা বাজার রাস্তায় বেরুলে মাথা ঘোরে।
কবে যাবে পুরী-টুরীর দিকে?
যাব যাব, ব্যস্ত কী। কুমুদ হাসে, আচল ধরিয়া বিব্রত মতিকে কাছে টানিয়া বলে, একটা ঘরে শুধু আমরা দুজনে কেমন আছি! ভালো লাগে না মতি?
হুঁ, লাগে।
তারপর ভয়ে ভয়ে–যা বই পড় সারাদিন।
তুমিও পড়বে মতি, তুমিও পড়বে।
ব্যস, তারপর এক পেয়ালা চা খাইয়া কুমুদ আবার চিত। আবেগ-মূৰ্ছনায় একটা সম্পূর্ণতা মতির কখনও পাইবার উপায় নাই। খানিক অন্যমনস্ক চিন্তা, এক পরিচ্ছেদ বই, দশ মিনিট মতি-এ যেন পালা করা খেলা কুমুদের, বৈচিত্র্য সৃষ্টি!
ভালোবাসার এত ক্রমশ মতির ভালো লাগে না। তবে ছোট-বড় সেবার সুযোগ মতিকে কুমুদ অফুরন্তই দিয়াছে। মতি চা করে, খাবার দেয়, তৃষ্ণার জল যোগায়। দাড়ি কামানোর আয়োজন করে, ক্ষুর ধুইয়া সরঞ্জাম গুছাইয়া রাখে, কুমুদের টেরিও মতিই কাটে, দিয়াশলাই সিগারেট প্রভৃতি যোগান দেয়। আরও কত কী মতি করে।
একদিন কুমুদ বলিয়াছিল, পা-টা কামড়াচ্ছে বউ।
কেন?
এমনি কামড়াচ্ছে। কেউ যদি একটু টিপে দিত।
মতি আরক্ত মুখে বলিয়াছিল, চাকরকে ডেকে বলো না?
হোটেলের চাকর পা টিপবে? তবেই হয়েছে। দাও না, তুমিই একটু দাও না আস্তে আস্তে!
সেই হইতে দুপুরবেলা কুমুদের ঘুম পাইলে মতি তার পাও টিপিয়া দেয়। শহরের শব্দে তখন স্থানীয় একটু স্তব্ধতার চাপ পড়ে। এ সময়টা মতির মন ভারি খারাপ হইয়া যায়। কলের মতো এক হাতে কুমুদের পা টিপিতে টিপিতে অন্য হাতে তাহাকে চোখ মুছিয়া ফেলিতে হয়। নিজেকে কেমন বন্দিনী মনে হয় মতির। মনে হয়, কুমুদ তাকে চিরকাল এই ছোট ঘরটিতে পা-টেপানোর জন্য আটকাইয়া রাখিবে, তার খেলার সাথি কেহ থাকিবে না, আপনার কেহ থাকিবে না, মাঠ ও আকাশ আর জীবনে পড়িবে না চোখে, বালিমাটির নরম গেঁয়ো পথে আর সে পরিবে না হাঁটিতে।
সাত দিন। মোটে সাত দিন যে এখানে কাটিয়াছে মতির!
তারপর একটি দুটি করিয়া কুমুদের বন্ধুরা আসিতে আরম্ভ করে। প্রতিদিন ইহাদের সংখ্যা বাড়িতে থাকে। আশ্চর্য সব বন্ধু কুমুদের। এরকম লোক মতি জন্মে কখনও দ্যাখে নাই। আসিয়া দরজায় ঘা দেয়। কুমুদ বলে, কে?
আমি।
কুমুদ বলে, দরজা খুলে দাও মতি।
দরজা খুলিয়া মতি ঘরের কোণে সরিয়া যায়। সরাসরি ঘরে ঢুকিয়া কুমুদের বন্ধু বিছানায় বসে। প্রথমবার আসিয়া থাকিলে মতির দিকে চোখ পড়ায় খানিকক্ষণ তাকাইয়া থাকে।
কোথায় পেলি?
বন্ধু শুইয়া থাকিয়াই জবাব দেয়, বউ!
কুমুদু হাসে। ফস করিয়া দিয়াশলাই জ্বলিয়া সিগারেট ধরায়।
আর এক দফা মতিকে দেখিয়া বলে, চা করো দিকি বউদি। চিনি কম, কড়া লিকার।
এবং পরক্ষণেই কুমুদের সঙ্গে গল্পে মশগুল হইয়া যায়। মতি গায়ের মেয়ে, বন্ধু যে লোক ভালো নয় সে তা বুঝিতে পারে। তবু আর যে সে একবারও তার দিকে ভালো করিয়া চাহিয়া দ্যাখে না, মতি তাতে আশ্চর্য হইয়া যায়। ভাবে, কুমুদের বন্ধু লোক যেমন হোক ভদ্রতা জানে। এমন ভাব দেখাইতে পারে যেন এঘরে শুধু বন্ধু আছে, বন্ধুর বউ নাই!