প্রথমে অনেক ভয়-ভাবনা ছিল, এখন শশীর মন উৎসাহে ভরিয়া উঠিয়াছে। বড় কিছু করিবার যে আগ্রহ চাপা পড়িয়া তাহাকে উতলা করিয়া তুলিয়াছিল, তারই যেন একটা মুক্তি হঠাৎ তাহার জুটিয়া গিয়াছে। সারাদিন জলকাদায় ছুটাছুটি করিয়া হিসাবের খাতাপত্র বগলে বাড়ি ফিরিয়া সে গভীর শ্রাস্তি ও নিবিড় তৃপ্তি অনুভব করে। জীবনে নতুনত্ব আসিয়াছে, বৈচিত্র্য আসিয়াছে। যাদবের কাছে সে বোধ করে কৃতজ্ঞতা। তার সম্বন্ধে গ্রামবাসীর মনে যে দ্রুত পরিবর্তন আসিতেছে তাতেও শশী এক উত্তেজনাময় আনন্দের স্বাদ পায়। এতদিন সে ছিল ডাক্তার, এবার যেন আপন হইতে ছোটখাটো একটি নেতা হইয়া উঠিতেছে। কাজের মানুষ বলিয়া গ্রামের ছেলেরা শশীকে এতদিন এড়াইয়া চলিত, এবার দল বাঁধিয়া আসিয়া কাজের নামে হৈচৈ করার সুযোগ প্রার্থন করিতেছে শশীর কাছে।-এই বর্ষায় গায়ে গায়ে শশীর নির্দেশমতো সকলে তাহারা চাঁদা সংগ্ৰহ করিতে ছুটিয়া গেল উখারায় পাশের গ্রামে কিসের সভা হইবে, ডাক আসিল শশীর কিছু বলা চাই। শুধু তাই নয়, গ্রামের সামাজিক ব্যাপারের জটলায় জীবনে এবার প্রথম ছেলেমানুষ শশীর আহবান হইল, সে গিয়া না-পৌঁছানো পর্যন্ত সভার কাজ স্থগিতও রাখা হইল। যারা বয়স্ক, শশীর বয়স যেন তারা ভুলিয়া গিয়াছেন।
কিন্তু সামাজিক ব্যাপারে শশী যোগ দিল না। সে জানে এ শুধু বার্ধক্যের অস্থায়ী আবেগ, যৌবনের সঙ্গে দুদিনের অন্ধ সন্ধি। আজ যে ইকা ও কাশির শব্দে মুখরিত সভায় তাকে সম্মানের আসন দেওয়া হইবে, কাল সেখানে তার জুটিবে টিটকরি!
এদিকে গেপাল কেমন যেন মুষড়াইয়া গেল। হাসপাতাল-সংক্রান্ত কোনো ব্যাপারে শশী যে তাকে হস্তক্ষেপ করিবার অধিকার দিল না তা যেন তাকে গভীরভাবে আঘাত করিল। উদ্ধত প্রকৃতি গোপালের, অভিমানী মন। শশী তার একমাত্র ছেলে। তার কাছে এমন ব্যবহার গোপাল কল্পনা করিতে পারিত না। মাঝে মাঝে সে অবাক হইয়া শশীর দিকে চাহিয়া থাকে, কিছু যেন বুঝিতে পারে না। ছেলের মনেও শ্রদ্ধা বজায় রাখিতে হইলে নিজের জীবনকে যে বাপের পর্যন্ত শ্রদ্ধার উপযুক্ত করিয়া রাখতে হয় এ শিক্ষা গোপালের ছিল না। অদৃষ্টকে দোষারোপ করিয়া সে তাই মনে-মনে হায় হায় করে। অনুতাপও যেন আসে গোপালের। মাঝে মাঝে সে ভাবে যে, যত অন্যায় করিয়াছে জীবনে এই তার শাস্তি!
একদিন সে শশীকে বলিল, জানিস শশী, অনেক পাপে ভগবান আমাকে তোর মতো ছেলে দিয়েছেন। তোর এত মহত্ত্ব কিসের তা কি আমি আর কিছু বুঝি না ভাবিস। আমার সঙ্গে রেষারেষি করিস তুই, আমাকে লজ্জা দেবার জন্য ন্যায়বান সেজে থাকিস!—মহত্ত্ব! বাপ পাপিষ্ঠ, উনি মহৎ লজ্জা করে না শশী তোর?
গোপালের মুখ দেখিয়া শশী একটু ভীতভাবে বলিল, আপনাকে আমি কখনও সমালোচনা করিনি বাবা।
অবিশ্বাস তো করিস।
শশী মৃদুস্বরে বলিল, কিছু বোঝেন না, যা-তা ভেবে রাগ করেন। এতে বিশ্বাসঅবিশ্বাসের কথা তো কিছুই নেই। আপনি যা বলেছিলেন তা যদি করতাম, লোকে বলত না বাপ-ব্যাটায় মিলে হাসপাতালের টাকা লুটছে?
কথাটা সাময়িকভাবে গোপালের কানে লাগে। তবে গোপালের অভিযোগ তো শুধু যাদবের টাকাগুলি নাড়াচাড়া করার অধিকার হইতে বঞ্চিত হওয়ার জন্য নয়। যত দিন যাইতেছে সে টের পাইতেছে, শশীর মনে, শশীর জীবনে তার স্থান আসিতেছে সংকুচিত হইয়া। শশী যে তাকে শুধু শ্রদ্ধা করে না তা নয়, সেজন্য আপসোসও যেন শশীর নাই। এইটুকুই গোপালকে পাগল করিয়া দিতে চায়।
গোপাল কত কী ভাবে। রাত্রে তার ঘুম হয় না। মাঝরাত্রে ঘুম ভাঙিয়া শশী তাহার তামাক টানার শব্দ শুনিতে পায়। সামান্য একটু সুবিধার জন্য মানুষের জীবন নষ্ট করিয়া যে মানুষটার একমুহুর্তের জন্য কখনও অনুতাপ হয় নাই, গভীর ও অপরূপ এক হীনতা থাকার জন্য যার কঠোর কর্মঠ প্রকৃতি শুধু নিষ্ঠুতায় গড়া; শশী কি তাকে ভাবপ্রবণ করিয়া তুলিল? সেনদিদির কাধে হাত রাখিয়া সে যখন শ্রান্ত গলায় বলে, জনিস সরোজ, ছেলেমেয়ের কাছ থেকে একদিনের তরে সুখ পেলাম না-তখন কাছে উপস্থিত থাকিলে শশী বোধ হয় চমকিয়া যাইত। সেনদিদির কাধে হাত রাখিবার জন্য নয়, গোপালের মুখ দেখিয়া, গলার স্বর শুনিয়া। হয়তো সে বুঝিতেও পারিত কত দুঃখে কানা সেনদিদির কাছে গোপাল আজ সাস্তুনা খুঁজিয়া মরে।
একদিন গোপাল একেবারে পাঁচশত টাকা শশীর হাতে তুলিয়া দিল।
কিসের টাকা?
হাসপাতাল ফন্ডে আমি দিলাম শশী।
শশী বলিল, মোটে পাঁচশো লোকে কী বলবে বাবা?
কী আশা করিয়াছিল গোপাল, কী বলিল শশী! নোটগুলি গোপাল ছিনাইয়া লইল, আগুন হইয়া বলিল, কত দেব তবে? লাখ টাকা? দেব না যা এক পয়সা আমি!
শশীকে ঘিরিয়া যখন এমনি গোলমাল চলিতেছে একদিন আসিল কুসুম, কয়েক দিন পরে আসিল মতির খবর।
১০. মতির কথা
মতির কথা গোড়া হইতে বলি।
রাজপুত্র প্রবীরকে স্বামী হিসাবে পাইয়া মতির সুখের সীমা নাই। গ্রাম ছাড়িতে চোখে জল আসে, অজানা ভবিষ্যতের কথা ভাবিয়া একটা রহস্যময় ভীতি বুক চাপিয়া ধরে, তবু আহ্বাদে মেয়েটা মনে মনে যেন গলিয়া গেল। এইটুকু বয়সে এমন উপভোগ্য মনকেমন-করা! স্টিমার ছাড়িলে জেটিতে দাঁড়ানো পরাণকে ঘোমটার ফাঁকে দেখিতে দেখিতে ভিতরটা যখন তোলপাড় করিতে লাগিল আর চোখের জল সব ঝাপসা হইয়া গেল, রাজপুত্র প্রবীর পাশে বসিয়া আছে অনুভব করার মধ্যেই তখন কী উত্তেজনা, কী আশ্বাস!