গোপাল বলিল, ব্যস্ত কি হই সাধে? তুই ছেলেমানুষ, কী করতে কী করে বসবি–
আপনার সঙ্গে পরামর্শ করেই করব।
একজন সৎকাজে যথাসর্বস্ব দান করিয়া গিয়াছে, আর একজন তাতে কিছু ভাগ বসাইতে চায়। কিছু ভালো লাগে না শশীর। অসংখ্য দুর্ভাবনা ঘনাইয়া আসে। এদিকে অবিশ্রাম বর্ষা নামিয়াছে। তাও অসহ্য। গ্রাম! কী শ্রীহীন কদার্য প্রকৃতির এই লীলাভূমি বর্ষার নির্মল বারিপাতে গলিয়া হইল পাক, পচিয়া হইল দুৰ্গন্ধ। পালানোর দিন আরও কতকাল পিছাইয়া গেল কে জানে। কুসুম ফিরিবার আগে গ্রাম ছাড়িতে পারিলে হইত। আর সে উপায় নেই! দেশে এত গণ্যমান্য লোক থাকিতে যাদব শেষে এমন বিপদে ফেলিয়া গেলেন তাহাকেই।
যাদবের মহামৃত্যুর উত্তেজনা এখনো কাটিয়া যায় নাই, উইলের খবরটা প্রকাশ পাওয়া মাত্র আর একদফা উত্তেজনার প্রবাহ বহিয়া গেল। শীতলবাবু শশীকে ডাকিয়া সব শুনিলেন, বলিলেন, পণ্ডিতমশাই বলে এবং তিনি স্বর্গীয় বলে শশী, নইলে, আমি থাকতে আমার গায়ে আমাকে ডিঙিয়ে হাসপাতাল দেবার স্পর্ধা কখনও সইতাম না। তা শোনো তোমার ফান্ডে আমি হাজার টাকা চাঁদা দেব।
শশীর ফান্ড! টাকাগুলি যাদব যেন শশীর কল্যাণেই দান করিয়া গিয়াছেন। গ্রামের মান্যবরেরাও সদলে শশীর কাছে যাতায়াত শুরু করিলেন। শীতলবাবুর মতো মনে সকলের আঘাত লাগিয়াছে। এতসব ধনী নামি বয়স্ক লোক থাকিতে এতবড় একটা ব্যাপারের সম্পূর্ণ ভার শশীকে দিয়া গেলেন, কী বিস্ময়ের কাণ্ড যাদবের কী অপমান সকলের অপমান বোধ করিয়াও তাহারা কিন্তু থাকিতে পারলেন না দূরে, শশীকে ছকিয়া ধরিলেন। তিনজনের বদলে অযাচিতভাবে পরামর্শদাতা ত্রিশজন সভ্যের কমিটিই যেন গড়িয়া উঠিল শশীকে ঘিরিয়া। আর গোপাল অবিরত ছেলের কানে মন্ত্র জপিতে লাগিল, পারবি না শশী তুই, পারবি না,-আমায় ছেড়ে দে সব।
যাদবের ভাঙা ঘরের চাবি গ্রামের জমিদার হিসাবে শীতলবাবুর কাছে জমা ছিল। একদিন দেখা গেল তালা ভাঙিয়া ঘরের জিনিসপত্র কে তছনছ করিয়াছে, এখানে ওখানে শাবল দিয়া করিয়াছে গভীর গর্ত। ঘটিবাটি কয়েকটি যায় নাই দেখিয়া বোঝা গেল ঘরে ছ্যাঁচড়া চোর আসে নাই, আসিয়াছিল কল্পনাপ্রবণ অনুসন্ধিৎসু,–গুপ্তধনের সন্ধানে।
শ্রীনাথ চেঁচাইয়া বলিতে লাগিল, মরবে ব্যাটারা, মরবে।-যে হাত দিয়া শাবল ধরেছিল খসে খসে পড়বে ব্যাটাদের।
আইনঘটিত হাঙ্গামাগুলি সহজে মিটিল না। সাধারণের উপকারার্থে দান করা অর্থের উপর একজন যুবকের অধিকার, উইলে স্পষ্ট লেখা থাকিলেও, আইনের চোখে কেমন কটু ঠেকিতে লাগিল। কোন পক্ষ হইতে ঠিক বোঝা গেল না, সম্ভবত আকাশ ফুড়িয়া গোপাল দাসের ছেলেটার পকেটে এতগুলি টাকা আসিবার সম্ভাবনায় গায়ে যাদের ধরিয়া গিয়াছিল জ্বালা, তাদের পক্ষ হইতেই তদ্বিরের ফলে, উইলের কয়েকটা গলদ বাহির করিয়া উইল বাতিল করার চেষ্টাও হইল হইল। অনুসন্ধান হইল অনেক, শশী বাজিতপুরে ছুটাছুটি করিল অনেকবার, উইলের সাক্ষীদের অনেক জেরা করা হইল, তারপর বেওয়ারিশ যাদবের অর্থ ও সম্পত্তি দিয়া গাওদিয়া হাসপাতাল করিবার অধিকার শশী পাইল। কমিটি গঠন করিবার সময় শশী পড়িল আর এক বিপদে কাকে রাখিয়া কাকে আহবান করিবে? উইলে নির্দেশ আছে মান্যগণ্য তিনজন বয়স্ক ভদ্রলোক। মান্যগণ্য ভদ্রলোকের অভাব নাই, কিন্তু শশী যাদের মানে, কমিটিতে আসিলে শশীকে তারা মানিবেন না, শশীর যারা অনুগত তারা আসিলে অনুগতেরা অগ্নিশৰ্মা হইয়া উঠিবে। শীতলবাবুকে অনুরোধ করিতে তিনি অস্বীকার করিলেন, রাগও করিলেন। শশী কর্তালি করিবে, গ্রামের জমিদার, তিনি শুধু দিবেন পরামর্শ? স্পর্ধা বটে শশীর।
শশী সবিনয়ে বলিল, আমি কেন, আপনিই সব বিষয়ে হেড থাকিবেন।
উইলে তো কই তা লেখেনি বাপু?
অবস্থা বিবেচনা করিয়া শশী তখন বলিল, তবে থাকে, ব্যস্ত মানুষ আপনি, এসব হাঙ্গামায় আপনার থেকে কাজ নেই। হাসপাতাল হলে যে স্থায়ী কমিটি হবে আপনাকে তো তার প্রেসিডেন্ট হতেই হবে। মাঝে মাঝে আমি আসব, উপদেশ নিয়ে যাব আপনার। আপনি সহায় না থাকলে এতবড় ব্যাপার আমি কেন সামলাতে পারব বলুন?
প্রেসিডেন্ট হতে হবে নাকি আমায়?
আপনি থাকতে আর কে প্রেসিডেন্ট হবে?–শশী যেন আশ্চর্য হইয়া গেল।
তখন প্রীত হইয়া শীতল শশীকে খাতির করিয়া বসাইলেন, হুকুম দিলেন জলখাবার আনিবার। বলিলেন, আর কে কে থাকিবে কমিটিতে?
শশী বলিল, কাকে নিয়ে সুবিধা হয় আপনিই যদি তা বলে দিতেন–
শীতল বলিলেন, আমাদের মুনসেফকে নাও না, উখারার সত্যহরিবাবুকে? আইনজ্ঞ মানুষ।
শশী বলিল, বলব ওঁকে। তা হলে দুজন হল—আপনি আর সত্যহরিবাবু। আরও একজন চাই। সাতগাঁর হেডমাস্টার কেশববাবুকে নিলে কেমন হয়?
এমন কৌশলে শীতলকে বশ করিতে পারায় এবার সহজেই যথারীতি কমিটি গঠিত হইল। শীতলের গৃহে সভ্যেরা একত্র হইয়া পরামর্শ করিতে লাগিলেন। মতান্তরের যে আশঙ্কা শশীর ছিল, দেখা গেল সেটা প্রায় অমূলক। মতান্তরের ভয়টা তার চেয়ে ওঁদেরও কম নয়। বিনয় ও নম্রতার মধ্যেও কোনো বিষয়ে শশীর দৃঢ়তা উকি দিলে শীতলও সে বিষয়ে আর প্রতিবাদ করেন না, সংঘর্ষ বাঁচাইয়া চলেন। সত্যহরি ও কেশৰ বৃদ্ধ, অত্যন্ত নিরীহ মানুষ। ঠিক হইল, ফল্ড খুলিয়া চাদা তোলা হইবে, যাদবের ভাঙা বাড়ি ও জমি বেচিয়া সাতগাঁ, উখরা ও গাওদিয়ার সংযোগস্থলে হাসপাতালের জন্য জমি কেনা হইবে। শীতলের সভাপতিত্বে একদিন গ্রামে একটা সভা হইয়া গেল। সভায় নিজের বক্তৃতা শুনিয়া নিজেই শশী হইয়া গেল অবাক। কে জানিত সে এমন সুন্দর বলিতে পারে। সভায় যথেষ্ট উৎসাহ ও উত্তেজনার সৃষ্টি হইয়াছিল বটে কিন্তু শেষের দিকে হঠাৎ মুষলধারে বৃষ্টি নামায় উত্তেজনা একটু নরম হইয়া আসিল। ছেলেরা চাদরের প্রান্ত ধরিয়া অর্থ সংগ্রহের জন্য সভায় ঘুরিতে আরম্ভ করা মাত্র মেঘের অজুহাতে অনেকে বাড়িও চলিয়া গেল।