কুসুম হঠাৎ মুখ তুলিয়া বলিল, হাতে ব্যথা বলে ওষুধ নিতে এলাম, এসব আমাকে কি শোনাচ্ছেন?
শশী থতমথত খাইয়া গেল। তারপর শুদ্ধস্বরে বলিল, কী বললে? ওষুধ নিতে এসেছ?
হাতটার ব্যথা সইতে পারি না ছোটোবাবু।
শশী স্নানমুখে বলিল, হাতের ব্যথার ওষুধ তো জানি না বউ। মালিশের ওষুধ যা দিয়ে এসেছি তাই মালিশ করো গে।–কী করে যাবে এই বৃষ্টিতে?
কী করে এলাম?—বলিয়া কুসুম দরজা খুলিয়া বৃষ্টির মধ্যে নামিয়া গেল। চলন দেখিয়া মনে হইল না কাল সে কোমরে চোট খাইয়া শয্যাগত ছিল। শশীর মনে বর্ষার মতো বিষন্নতা ঘনাইয়া আসে। কুসুম শেষে এমন দুর্বোধ্য হইয়া উঠিল! সে কত আশা করিয়াছিল কুসুম ধীর শাস্তভাবে তার সমস্ত কথা শুনিবে, সমস্ত বুঝিতে পারবে। কোথাও একটুকু না-বোঝার কিছু না-থাকায় তাদের দুজনের করো মনে দুঃখ থাকিবে না, অভিমান থাকিবে না, লজ্জাও থাকিবে না। বোঝাপড়া শেষ হইবে গভীর অন্তরঙ্গতায়,–নিবিড় সহানুভূতিতে। তার বদলে এ কী হইল? ভাবিয়া ভাবিয়া শশীর মনে হইল, গ্রাম্য মন কুসুমের, কিছু তার বুঝিবার ক্ষমতা নাই।
পরদিন পরাণের কাছে সে খবর পাইল, কুসুমের হাত আর কোমরের ব্যথা কমিয়াছে, কাল সে বাপের বাড়ি যাইবে।
কদিন থাকবে বাপের বাড়ি?
বলছে তো পুজো পেরিয়ে আসবে। কদিন থাকে এখন।
তোমার কষ্ট হবে পরাণ।–শশী বলিল।
পরাণ গম্ভীরমুখে বলিল, কিসের কষ্ট, দুবেলা ভাত দুটো মা-ই ফুটিয়ে দিতে পারবে। ভেবেচিন্তে আমিই একরকম পাঠাচ্ছি ছোটোবাবু। বাপের বাড়ি যেতে না পেলে মেয়েমানুষের মাথা বিগড়ে যায়।
রাত্রে কিছু ঠিক ছিল না, ভোর রাত্রে গোবর্ধন এবং আরও দুজন মাঝিকে তুলিয়া শশী বাজিতপুরে যাইবে বলিয়া বাহির হইয়া পড়িল। একা বাজিতপুর যাইতে বড় নৌকা সে ব্যবহার করে না, ছোট নৌকোয় গোবর্ধন একাই তাহাকে লইয়া যায়। আজ তাহার বড়ো নৌকাটির প্রয়োজন হইল কেন কেহ বুঝিতে পারিল না। বিছানা পাতিয়া, জলের কুঁজো, বাড়ির তৈরি খাবার ভরা টিফিন ক্যারিয়ার, এক ডালা পাকা আম, চায়ের সরঞ্জাম, ওষুধের ব্যাগ প্রভৃতি নৌকায় তুলিয়া গোবর্ধন সব ঠিক করিয়া ফেলিল। শশী কিন্তু নৌকা খুলিল না। তীরে দাঁড়াইয়া টানিতে লাগিল সিগারেট।
রোদ উঠিবার পর কুসুমের ভুলি আসিল ঘাটে। সঙ্গে অনন্ত আর পরাণ। শশীকে দেখিয়া পরাণ বলিল, ছোটোবাবু যে এখানে?
শশী বলিল, বাজিতপুর যাব পরাণ। তোমাদের জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম। তোমাদের ও ছোট নৌকায় এদের দিয়ে কাজ নেই, বাজিতপুর পর্যন্ত আমার নৌকায় চলো। সেখানে ভালো দেখে একটা নৌকা ঠিক করে দেব।
তাই হোক। কারো আপত্তি নাই।
পরাণকে ধরিয়া কুসুম শশীর নৌকায় উঠিল। তার তোরঙ্গ, বোঁচকা ও অন্য সব জিনিস তোলা হইলে শশী বলিল, তুমি ছইয়ের মধ্যে বিছানায় বসবে যাও বউ। সামনের দিকে এগিয়ে বসো, তাহলে চাদ্দিক দেখে যেতে পারবে।
০৯. নৌকার দোলনে দুলিয়া
নৌকার দোলনে দুলিয়া চুলিয়া কুসুমের বাবার ঘুম আসে। কুসুম ছইয়ের মধ্যে পিছনে হালের দিকে তাহার শোবার ব্যবস্থা করিয়া দিল। সে ঘুমাইয়া পড়িলে শশীকে ডাকিয়া বলিল, হঠাৎ আমাকে বাপের বাড়ি পৌঁছে দেবার শখ হল কেন শুনি?
বলিয়া মৃদু হাসিল কুসুম।
শশী বলিল, তুমি ভাবছ কাজ নেই, না? তোমার জন্য যাচ্ছি শুধু? উকিলের সঙ্গে দেখা করব।
মামলা আছে বুঝি?
মামলা তো দুটো-একটা লেগেই আছে, সেজন্য নয়। কী কারণে যেতে লিখেছেন, জরুরি। তবে আজ না-গেলেও চলত।
কুসুম একটু হাসিল।
আড়চোখে একবার বাপের দিকে চাহিয়া কুসুম বলিল, আমার জন্য এলেন আজ, না?
শশী বলিল, হ্যা।
গভীর সুখে কুসুমের মুখখানা উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। তবু নিশ্বাস ফেলিয়া দুঃখের সঙ্গেই বলিল, ভেবেছিলাম বাপের বাড়ি গিয়ে কমাস থাকব, তা আর হবে না বুঝতে পারছি।
আশ্চর্য চরিত্র কুসুমের! এতক্ষণে শশী একটু লজ্জা বোধ করিলা সেদিন রহস্য সৃষ্টি করে নাই কুসুম। ওরকম বাঁকা তার মনের কথা বলিবার ধরন। সে কিছু বুঝিবে না, কিছু মানিবে না। কেন ভাবিয়া মরে শশী? সেদিন কুসুমের ব্যবহারের মানে ছিল শুধু এই। আর এক বিষয়ে শশী বিস্মিত হয়! সেদিন সে গ্রাম ছাড়িয়া চলিয়া যাইবার কথা বলিয়াছিল। সে সম্বন্ধে কুসুমের কি বলিবার কিছু নাই? কথাটা সে বিশ্বাস করে নাই নাকি?
বাজিতপুরের ঘাটে নৌকা বাঁধিয়া শশী নামিয়া গেল। গোবর্ধনকে বলিয়া দিল, কুসুমকে বাপের বাড়ি পৌঁছাইয়া দিয়া বিকালে যেন নৌকা আনিয়া ঘাটে রাখে।
বাজিতপুরের সিনিয়র উকিল রামতারণবাবুর কাছে মকদ্দমা উপলক্ষে শশীকে মাঝে মাঝে আসিতে হয়, এবারেও দেখা করিবার জন্য দিনতিনেক আগে তার একখানা চিঠি পাইয়া শশীর কোনো অসাধারণ প্রত্যাশা জাগে নাই। ব্যাপার শুনিয়া খানিকক্ষণ তাই সে বিস্ময়ে হতবাক হইয়া রহিল। দশটা গ্রামকে বিচলিত ও উত্তেজিত করিয়া যাদব মরিয়াছেন, কিন্তু আরও যে চমক তিনি সঞ্চিত করিয়া রাখিয়া গিয়াছেন সকলের জন্য, শশী তো তাহা ভাবিতেও পারে নাই।
গ্রামে একটি হাসপাতাল করার জন্য যা-কিছু ছিল যাদবের, সব তিনি দান করিয়া গিয়াছেন। ব্যবস্থার ভার শশীর, দায়িত্ব শশীর।
কী ছিল যাদবের? হাসপাতাল করার উপযুক্ত দান হিসাবে অত্যধিক কিছু নয়, যাদবের দান হিসাবে বিস্ময়কর, প্রচুর। হাজার পনেরো টাকার কোম্পানির কাগজ, বারো-তেরো হাজার নগদ, আর যেখানে যাদব বাস করিতেন সেই বাড়ি ও জমি। এত টাকা ছিল যাদবের? পুরানো ভাঙা বাড়িটার সাতস্যাতে ঘরে যাদব ও পাগলদিদির সাদাসিধে ঘরকন্নার ছবি শশীর মনে পড়িতে লাগিল, ক-খানা বাসন, মাটির হাড়িকলসি, কাঠের জীর্ণ সিন্দুক-গৃহসজ্জার অভাবজনিত দীনতা। তাও অপূর্ব ছিল সত্য,– সে ঘরের পরিচ্ছন্নতা, ধূপগন্ধী শান্ত আবহাওয়া চিরদিন শশীকে অভিভূত করিয়াছে, কিন্তু টাকার ছাপ তো কোথাও ছিল না সেই গৃহী সন্ন্যাসীর গৃহে!