তারপর ছেলেদের চেষ্টায় জনতা ঠেকাইবার ব্যবস্থা হইলে শয্যা রচনা করিয়া পাশাপাশি দুজনকে শোয়োনো হল। কায়েতপাড়ার সংকীর্ণ পথে কোনোবার রথ চলে নাই, শীতলবাবুর হুকুমে বেলা প্রায় তিনটার সময় বাবুদের রথটি অনেক চেষ্টায় যাদবের গৃহের সম্মুখে পর্যন্ত টানিয়া আনা হইল। পাগলদিদিকে কোনোমতে চোখ মেলানো গেল না, যাদব কষ্টে চোখ মেলিয়া একবার চাহিলেন। চোখের তারাদুটি এখন তাহার আরও ছোট হইয়া গিয়াছে।
তারপর যাদবও আর সাড়াশব্দ দিলেন ন। সকলে বলিল, সমাধি। পাগলদিদি মারা গেলেন ঘণ্টাখানেক পরে, ঠিক সময়টি কেহ ধরিতে পারিল না। একটি ব্রাহ্মণ সধবা গঙ্গাজলে মুখের ফেনা ধুইয়া দিলেন। যাদবের শেষ নিশ্বাস পড়িল গোধূলিবেলায়।
শশীর স্পর্শ করিবার অধিকার নাই! তফাত হইতে সে ব্যাকুলভাবে বলিল—ওঁর মুখে কেউ গঙ্গাজল দিন।
সত্যি-মিথ্যায় জড়ানো জগৎ। মিথ্যারও মহত্ত্ব আছে। হাজার হাজার মানুষকে পাগল করিয়া দিতে পারে মিথ্যার মোহ। চিরকালের জন্য সত্য হইয়াও থাকিতে পারে মিথ্যা। যারা যাদব ও পাগলদিদির পদধূলি মাথায় তুলিয়া ধন্য হইয়াছিল, তাদের মধ্যে কে দুজনের মৃত্যুরহস্য অনুমান করিতে পরিবে? চিরদিনের জন্য এ ঘটনা মনে গাঁথা রহিল, এক অপূর্ব অপার্থিব দৃশ্যের স্মৃতি। দুঃখযন্ত্রণার সময় একথা মনে পড়িবে। জীবন রুক্ষ নীরস হইয়া উঠিলে এ আশা করিবার সাহস থাকিবে যে, খুঁজিলে এমন কিছুও পাওয়া যায় জগতে, বাঁচিয়া থাকার চেয়ে যা বড়। শোক, দুঃখ, জীবনের অসহ্য ক্লাস্তি—এসব তো তুচ্ছ, মরণকে পর্যন্ত মানুষ মনের জোরে জয় করিতে পারে। কত সংকীর্ণ দুর্বল চিত্তে যে যাদব বৃহতের জন্য, মৃদু হোক, প্রবল হোক, ব্যাকুলতা জাগাইয়া রাখিয়া গিয়াছেন, শশী তাই ভাবে। যখন ভাবে, তখন আপিমের ক্রিয়ায় যাদবের চামড়া ঢাকিয়া চটচটে ঘাম, বিন্দুর মতো ছোটো হইয়া আসা চোখের তারকে আর মুখে ফেনা উঠিবার কথা সে ভুলিয়া যায়।
বর্ষা আসিয়াছে। খালে জল বাড়িল, ডোবা-পুকুর ভরিয়া উঠিল। চারিদিকে কাদা, ভাঙা পথে কোথাও যাওয়া মুশকিল। পালকি-বেহারাদের পা কাদায় ডুবিয়া যায়, ধীরে ধীরে চলিতে হয়। এমনি বৃষ্টিবাদলার মধ্যে একদিন কুসুমের বাবা মেয়েকে লইয়া আসিল। সেইদিন তালপুকুরের ধারে কুসুম কেমন করিয়া পড়িয়া গেল সে-ই জানে। বলিল, কোমরে চোট লাগিয়াছে আর হাতটা গিয়াছে ভাঙিয়া।
কী করে যাব তোমার সঙ্গে? আমি তো যেতে পারব না বাবা! পুজোর সময় এসে আমারয় নিয়ে যেয়ো।
কুসুমের বাবা অত্যন্ত আপসোস করিয়া বলিল, কতকাল যাওয়া হয়নি, তোর মা কাঁদাকাটা করেন কুসি। দুটো দিন বরং দেখে যাই, ব্যথাটা যদি কমে।
কুসুম বলিল, দু-চার দিনে এ ব্যথা কি কমবে বাবা? কোমরের ব্যথায় নড়তে পারি না। হাড়-টাড় কিছু ভেঙেছে নাকি কে জানে!
হাতটা সত্যই মচকাইয়া গিয়াছিল। শশী আসিয়া পরীক্ষা করিবার সময় এক ফাঁকে জিজ্ঞাসা করিল, ইচ্ছে করে পড়নি তো বউ?
কী যে বলেন ছোটোবাবু! ইচ্ছে করে পড়ে কেউ কোমর ভাঙে?
হাতে তবে তোমার কিছু হয়নি, শুধু কোমর ভেঙেছে, না?
হাতও ভেঙেছে।–কুসুম বলিল।
শশী হাতটা নাড়িয়া চাড়িয়া বলিল, কই, বেশি ফোলেনি তো?
কুসুম রাগিয়া বলিল, আবার কী ফুলবে ছোটোবাবু, ফুলে কি ঢোল হবে?
পরদিন দুপুরবেলা আকাশ-ঢাকা মেঘে চারিদিকে অন্ধকার হইয়া আসিয়াছিল। শশী বসিয়া ছিল নিজের ঘরে। গ্রামাস্তরে রোগী দেখিতে যাইবার কথা ছিল, মেঘ দেখিয়া বাহির হয় নাই। নানা কথা ভাবিতে ভাবিতে জোরে বৃষ্টি নামিয়া আসিল। পরক্ষণে আসিল কুসুম। হাতের ব্যথা সহিতে না পারিয়া ওষুধ লইতে আসিয়াছে।
শশী বলিল, হাতে এমন কী ব্যথা হল যে, এ বৃষ্টি মাথায় করে ওষুধ নিতে এলে? এলেই বা কী করে? কোমর না তোমার ভেঙে গেছে?
কুসুম অস্পষ্টভাবে বলিল, কষ্ট করে এলাম।
কেন তা এল? বিকেলে আমিই তো যেতাম।
সইতে পারি না ছোটোবাবু।
এবার শশী একটু বিবর্ণ হইয়া গেল। চিরকাল এমনভাবে চলিবে না সে জানিত, একদিন ছেলেখেলায় আর কুলাইবে না। তবু এমন বাদলায় কুসুম বোঝাপড়া করিতে আসিল? কুসুমকে দোষ দেওয়া যায় না। ভাসা-ভাসা হালকা ভাবের আড়াল দিয়া এই দিনটিকে এড়াইয়া চলিবার চেষ্টা বড় নির্মম। কুসুম যে এতদিন সহ্য করিয়াছে তাই আশ্চর্য। যাই থাক তার মনে, কুসুমের কী আসিয়া যায়? সে কেন চিরকাল তার ভীরু নীরবতাকে প্রশ্রয় দিয়া যাইবে? দীর্ঘকাল ধরিয়া কুসুমের প্রতি নিজের অন্যায় ব্যবহার মনে করিয়া শশীর লজ্জা বোধ হইল।
মৃদুস্বরে সে বলিল, কিছু মনে কোরো না বউ, আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল।
কুসুম কথা বলিল না, শশী যেন তাতে আরও বিবর্ণ হইয়া গেল। জানালা দিয়ে ঘরে ছাট আসিতেছিল। উঠিয়া জানালাটা বন্ধ করিয়া এতক্ষণে সে হঠাৎ অত্যন্ত বেখাপ্পা ভদ্রতা করিয়া বলিল, বোসো না বউ, বোসো ওইখানে।
কুসুম বসিল এবং বসিয়া যেন বাঁচিল। শশী আরও মৃদুস্বরে বলিল, অনেক দিন থেকে তোমায় কটা কথা বলব ভাবছিলাম বউ। বলি বলি করে বলতে পারিনি। বলা কিন্তু দরকার,–নয়? আমরা ছেলেমানুষ নই, ইচ্ছে হলেই একটা কাজ কি আমরা করতে পারি? সুঝে-বুঝে কাজ করা দরকার। এই তো দ্যাখো পরাণ আমার বন্ধু, উপকার করতে গিয়ে চিরকাল শুধু অপকারই করেছি। তবু, তাও আমি গ্রাহ্য করতাম না বউ। এই বৃষ্টিতে তুমি এলে, তোমার কাছে সরে বসতে না পেরে আমার যা কষ্ট হচ্ছে, কারো মুখ চেয়ে আমি তা সইতাম না। কিন্তু আমি গাঁয়েই থাকব না বউ। আজ বাদে কাল চলে যাব বিদেশে, আর কখনও ফিরব না। এরকম অবস্থায় একটু মনের জোর করে–