নেই? কত আজেবাজে কথা আছে, সীমা নেই তার।
বলিয়া কুসুম হাসে। শশী বলে, হালকা ভাবটা একটু কমাও বউ। বাপের বাড়ি যাবে তো শুনছি ঢের দিন থেকে, যাওয়া তো হল না।
কুসুম সপ্রতিভভাবেই বলে, যেতে যে পারি না।
তারপর বলে, যেসব মজার কাণ্ড গাঁয়ে। সত্তর বছরের একটা বুড়ো মরবে, তাই নিয়ে দশটা গাঁয়ের লোক হৈ হৈ করছে। বেঁচে থাকলে আরও কত দেখব!
কুসুমের এ ধরনের কথাবার্তা শশীর যে খুব ভালো লাগিল তা নয়, তবু একা একা ভাবিতে ভাবিতে মনের মধ্যে যে বদ্ধ আবহাওয়ার সৃষ্টি হইয়াছিল, খানিকট খোলা বায়ু আসিয়া তা যেন কিছু হালকা করিয়া দিল। তাই বটে। এত সে বিচলিত হইয়াছে কেন একটা গ্রাম্য ব্যাপারে? মরেন, তো মরিবেন যাদব, তার কী আসিয়া যায়? দুদিন পরে এ গাঁয়ে বাস করিবার স্মৃতিটুকু মনে আনিবার সময়ও কি থাকিবে তাহার?
বিকালে সেদিন শ্রীনাথ আসিয়া শশীকে ডাকিয়া গেল। পরদিন আসিলেন পাগলদিদি স্বয়ং। না গিয়া শশীর উপায় থাকিল না।
পাগলদিদি বলিলেন, তীর্থে যাবার কথা তো বলে এলি ভাই, গিয়ে কী হবে? দল বেঁধে গায়ের লোক সঙ্গে যাবে। এতলোক দিনরাত পাহারা দিচ্ছে, সকলের নজর এড়িয়ে পালাব কোথা?
একটু যেন গা-ঝাড়া দিয়া উঠিয়াছেন পাগলদিদি, কোনোদিকে আশার আলো দেখিতে পাইছেন কি-না কে জানে। মুখখানা খুব বিষন্ন কিন্তু শান্ত, ভয় ও উদ্বেগের ছাপটা গিয়াছে। চলিতে চলিতে বলেলেন, পালিয়ে গিয়েই বা কী হবে বলো? ক বছর আর বাঁচিব। বিদেশে নতুন লোকের মধ্যে কত কষ্ট হবে, মনে একটা আপসোসও থাকবে। অমন করে দুটো একটা বছর বেশি বেঁচে থেকে সুখটা কী হবে, তাই ভাবে। তার চেয়ে এভাবে যাওয়া ঢের বেশি গৌরবের।
শশী বলিল, কিন্তু নিজের ইচ্ছায় যখন খুশি কেউ কি যেতে পারে দিদি?
ও যে সিদ্ধিলাভ করেছে পাগল। ওর অসাধ্য কিছু আছে?
পাগলদিদি বোধহয় লুকাইয়া আসিয়াছিলেন, তাহাকে দেখিবামাত্র একদল নরনারী আসিয়া ছাঁকিয়া ধরিল। শশীর সঙ্গে অতি কষ্টে বাড়িতে ঢুকিয়া তিনি দরজা বন্ধ করিয়া দিলেন। ভিড় পাগলদিদির সহ্য হয় না। তাহাকে দেখিবার জন্যও জনতা চেঁচামেচি করে কিন্তু তিনি কখনও বাহিরে আসেন না। তেল সিঁদুর হাতে করিয়া মেয়েরা তাহার রুদ্ধ দরজার সম্মুখ হইতে ফিরিয়া যায়।
যাদব ভিতরে আসিয়া বলিলেন, শশী এসেছ? সেদিন একটু বকেছিলাম বলে রাগ করে কদিন আর দেখাই দিলে না ভাই! তোমার কথা ভাবছিলাম শশী কত ক্ষতি করে গিয়েছিলে সেদিন, তোমার সে ধারণা নেই, মায়ার বশে কুপরামর্শ দিয়ে গেলে, থেকে থেকে কথাটা বিমনা করে দিয়েছে, সহজে তুচ্ছ তো করতে পারি না তোমার কথা।
অনেক কথা বলেন যাদব; তিনি তো চলিলেন, পাগলদিদিকে শশী যেন দেখাশোনা করে। এতকাল অসুখবিসুখ হইলে সূর্যবিজ্ঞানের জোরে আরোগ্য তিনিই করিয়াছেন, এবার হয়তো শশীর ওষুধ খাইতে হইবে। -শিখলে পারতে শশী সূর্যবিজ্ঞান। বামুনের ছেলে নও, মন্ত্রশিষ্য তোমাকে করতে পারি না, বিদ্যেটা শিখিয়ে দিতে পারতাম। শিখবে? যাদব হাসিলেন।–আর তো শেখবার সময় নেই শশী!
রথের দুদিন আগে খুব বৃষ্টি হইয়া গিয়াছিল। সেদিনও সকালের দিকে কখনও গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়িল, কখনও মেঘলা করিয়া রহিল। আগের দিন সন্ধ্যা হইতে সংকীর্তন আরম্ভ হইয়াছিল, সারারাত্রি একমুহূর্ত বিরাম হয় নাই। সকালবেলা নূতন নূতন লোক আসিয়া দল ভারী করিয়াছে, কীর্তন আরও জাকিয়া উঠিয়াছে। যাদব স্নান করিয়া পট্টবস্ত্র পরিধান করিয়াছেন, সকালে ফুলের মালায় তাহাকে সাজাইয়াছে। পাগলদিদিও আজ রেহাই পান নাই, তার গলাতেও উঠিয়াছে অনেকগুলি ফুলের মালা। তবে তেল সিঁদুর দেয়া সধবারা বন্ধ করিয়াছে। আজ যার বৈধব্যয়যোগ তাকে ওসব আর দেয়া যায় না। বেলা বাড়িবার সঙ্গে যাদবের বাড়ির সামনে আর কায়েতপাড়ার পথে লোকে লোকারণ্য হইয়া উঠিল। গাওদিয়া, সাতগাঁ আর উখার গ্রামের একদল ছেলে ভলান্টিয়ার হইয়া কাজ করিতেছে, উৎসাহ তাদেরই বেশি। বাঁশ বাঁধিয়া দর্শনার্থী মেয়ে-পুরুষের পথ পৃথক করি দেওয়া হইয়াছে। ভাঙা দাওয়ায় যাদবের বসিবার আসন। অঙ্গনে কয়েকটা চৌকি ফেলিয়া গ্রামের মাতব্বরেরা বসিয়াছেন। তাদের হুঁকা টানা ও আলাপ-আলোচনার ভঙ্গি উৎসব-বাড়ির মতো। যেন বিবাহ উপনয়ন সম্পন্ন করাইতে আসিয়াছেন। শীতলবাবু ও বিমলবাবু সকালে একবার আসিয়াছিলেন, দুপুরে আবার আসিলেন। বাবুদের বাড়ির মেয়েরা আসিলেন অপরাষ্ট্রে। যাদব এবং পাগলদিদির তখন মুমূর্ষ অবস্থা।
শশী আগাগোড়া দুজনকে লক্ষ করিয়াছিল। বেলা এগারোটার পর হইতে দুইজনেই ধীরে ধীরে নিস্তেজ ও নিদ্রাতুর হইয়া আসিতেছেন দেখিয়া, মনের মধ্যে তাহার আরম্ভ হইয়াছিল তোলপাড়। আরও খানিকক্ষণ পরে শশীর দিকে ঢুলঢুল চোখ মেলিয়া একবারমাত্র চাহিয়া যাদব এক অদ্ভুত হাসি হাসিয়াছিলেন, পাগল দিদি তখন চোখ বুজিয়াছেন। যাদবের মুখ ঢাকিয়া গিয়াছিল চটচটে ঘামে আর কালিমায়, চোখের তারা দুটি সংকুচিত হইয়া আসিয়াছিল। তিন-চার হাজার ব্যগ্র উত্তেজিত লোকের মধ্যে ডাক্তার শুধু শশী একা, সে শিহরিয়া উঠিয়াছিল। তবু পলক ফেলিতে পারে নাই। যাদব ও পাগলদিদির দেহে পরিচিত মৃত্যুর পরিচিত লক্ষণগুলির আবির্ভাব একে একে দেখিয়াছিল।
সকলে যখন টের পাইল যাদবের সঙ্গে পাগলদিদিও পরলোকে চলিয়াছেন, যাদবের আগেই হয়তো তাহার শেষ নিশ্বাস পড়িবে, চারিদিকে নূতন করিয়া একটা হৈচৈ পড়িয়া গেল। ছেলে-বুড়ো স্ত্রী-পুরুষ একেবারে যেন খেপিয়া উঠিল! ভলান্টিয়ারদের চেষ্টায় এতক্ষণ সকলের দর্শন ও প্রণাম শৃঙ্খলাবদ্ধভাবেই চলিতেছিল, এবার আর কাহাকেও সংযত করা গেল না। যাদব আর পাগলদিদি বুঝি পিষিয়াই যান ভিড়ে। পাগলদিদির দুটি পা ঢাকিয়া গেল সিঁদুরে।