পাগলদিদি কাতরকণ্ঠে বলেন, এ কী হল শশী?
শশী চুপচাপ ভাবে। একদিন সে যাদবকে বলে, পণ্ডিতমশায়, রথের দিন আমাদের ছেড়ে যাবেন যদি ঠিক করেই থাকেন, এখানে থেকে কী করবেন? পুরী চলে যান না? রথের আসল উৎসব হয় সেখানে, এখানে তো কিছুই নেই। বাবুদের রথ সবচেয়ে বড়, তাও তিন হাতের বেশি উঁচু হবে না। আপনার পুরী যাওয়াই উচিত।
যাদবের যেন চমক ভাঙে।–-পুরী যেতে বলছ?
শশীর ভয় যে পুরী যাইতে বলার আসল অর্থ যাদব হয়তো বুঝতে পারেন নাই। কত ভাবিয়া যাদবের সমস্যার এই সমাথা ন সে আবিষ্কার করিয়ারেছ। পুরী যান না যান যাদব, এতবড় দেশটা পড়িয়া আছে, পুরী যাওয়ার নাম করিয়া যেখানে খুশি তিনি চলিয়া যাইতে পারেন, বাস করিতে পারেন অজানা দেশে অচেনা মানুষের মধ্যে, রথের দিন না মরিলেও যেখানে তাহার লজ্জা নাই। স্পষ্ট করিয়া যাদবকে কথাটা বুঝাইয়া বলা যায় না। ভান তো যাদব শশীর কাছেও বজায় রাখিয়াছে। সে ইঙ্গিতে বলে—জিনিসপত্র নিয়ে পাগলদিদিকে সঙ্গে করে পুরই চলে যান পণ্ডিতমশায়,–গাঁয়ের লোক হৈচৈ করে যে কষ্টটা আপনাকে দিচ্ছে! শেষ সময়টা স্বস্তি পাচ্ছেন না। সেখানে কেউ আপনার নাগাল পাবে না।
পাগলদিদি মেঝেতে এলাইয়া পড়িয়া ছিলেন, সহসা উঠিয়া বসেন। যাদব সবিস্ময়ে চাহিয়া থাকেন শশীর দিকে। শশী আবার ইঙ্গিতে বলে, পুরী যাবার নাম করে বেরিয়ে পড়ুন। তারপর পুরীই যে আপনাকে যেতে হবে তার তো কোনো মানে নেই? অন্য কোনো তীর্থে যেতে চান, পথে মত বদলে তাই যাবেন। অচেনা লোকের মধ্যে শেষ কটা দিন শান্তিতে কাটিয়ে দিতে পারবেন। গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ে শশী, –বেয়াড়া গাঁয়ের লোকের হাত থেকে আপনার রেহাই পাবার আর তো কোনো পথ দেখতে পাই না।
কী বলছ শশী? শেষকালে পালিয়ে যাব?–যাদব বলেন।
পালিয়ে কেন? তীর্থে যাবেন।–বলে শশী।
যাদব কী ভাবেন কে জানে, দপ্ করিয়া জুলিয়া ওঠেন আগুনের মতো। রাগে কাঁপিতে কাঁপিতে বলেন-আমার সঙ্গে তুমি পরিহাস করছ শশী, ঠাট্টা জুড়েছ। আমি ভণ্ডামি আরম্ভ করেছি ভেবে নিয়েছ, না? কোনোদিন আমাকে তুমি বিশ্বাস করনি, চিরকাল ভেবে এসেছ সব ভড়ং,–লোক ঠকিয়ে আমি জীবন কাটিয়েছি! দুপাতা ইংরেজি পড়ে সবজান্তা হয়ে হয়ে উঠেছ, এসব তুমি কী বুঝবে? কী তুমি জানো যোগসাধনের? তুমি তো ম্লেচ্ছাচারী নাস্তিকা স্নেহ করি বলে কখনও কিছু বলিনি তোমাকে-উপদেশ দিয়ে ধর্মের কথা বলে বরং চেষ্টাই করেছি যাতে তোমার মতিগতি ফেরে। আসল শয়তান বাস করে তোমার মধ্যে, আমার সাধ্য কি কিছু করি তোমার জন্যে। যাও বাপু তুমি সামনে থেকে আমার, তোমার মুখ দেখলে পাপ হয়।
কে জানিত শশীকে যাদব এমন করিয়া বকিতে পারেন!
এ জগতে পাগলদিদির পর সে-ই যে তার সবচেয়ে মেহের পাত্ৰ!
মুখ দেখিলে পাপ হয়! ম্লেচ্ছাচারী, নাস্তিক মরণ অথবা অপযশের মধ্যে একটা যাকে বাছিয়া লইতে হইবে কদিনের মধ্যে, তাকে বাঁচিবার উপায় বলিয়া দিতে যাওয়ার কী অপরূপ পুরস্কার! যাদবের তিরস্কারে শশী ছেলেমানুষের দুঃখে অভিমানে কাতর হইয়া থাকে।
তবে কি যাদব সত্যিই রথের দিন দেহত্যাগ করবেন? মৃত্যুর ওই দিনটি যে তাহার নির্ধারিত হইয়া আছে, যোগের শক্তিতে বহুদিন হইতেই যাদব তবে তাহা জানিয়া রাখিয়াছিলেন? তা যদি হয় তবে সন্দেহ নাই যে সে মেচ্ছাচারী নাস্তিক। এখন তো তাহার বিশ্বাস হয় না যে মানুষ নিজের ইচ্ছায় মরিতেও পারে, মরিবার আগে জানিতে পারে কবে মরণ হবে।
বিশ্বাস হয় না, তবু শশীর মনের আড়ালে লুকানো গ্রাম্য কুসংস্কার নাড়া খাইয়াছে। এক এক সময় তাহার মনে হয়, হয়তো আছে, বাধা যুক্তির অতিরিক্ত কিছু হয়তো আছে জগতে, যাদব আর যাদবের মতো মানুষেরা যার সন্ধান রাখেন। দলে দলে লোক আসিয়া যে যাদবের পায়ে লুটাইয়া পড়িতেছে, এদের সকলেরই বিশ্বাস কি মিথ্যা? সাধারণ মানুষের চেয়ে অতিরিক্ত কিছু যদি নাই থাকে যাদবের মধ্যে, এতগুলি লোক কি অকারণে এমনি পাগল হইয়া উঠিয়াছে? দশ-বারো ক্রোশ দূরবর্তী গ্রাম হইতে সপরিবারে গৃহস্থ আসিয়াছে, বাসা বাঁধিয়া আছে গাছতলায়। কত নরনারীর চোখে শশী জল পড়িতে দেখিয়াছে। কায়েতপাড়ার পথে নামিয়া দাঁড়াইলেই মনে হয় এ যেন তীর্থ। সকল বয়সের যে-সমস্ত নরনারী এদিক-ওদিক বিচরণ করিতেছে, প্রাত্যহিক জীবনে হিংসা-দ্বেষ স্বার্থপরতার সঞ্চিত গ্লানি তারা পিছনে ফেলিয়া আসিয়াছে; ভুলিয়া গিয়াছে পার্থিব সুখের কামনা, লাভের হিসাব। হয়তো সাময়িক, ফিরিয়া গিয়া সম্পূর্ণ জীবনের কদৰ্যতায় আবার সকলে মুখ গুড়িয়া দিবে, তবু ওদের মুখের উৎসুক একাগ্রতা আজ তো মুগ্ধ করিয়া দেয়।
সকলে যাদবকে লইয়া ব্যাপৃত থাকায় শশীর সঙ্গে দেখা করার সুবিধা হইয়াছে কুসুমের। সে উদ্বিগ্ন কষ্ঠে বলে, মুখ এত শুকনো কেন?
মনটা ভালো নেই বউ।
ওমা, কী হল মনের?
শশী বিরক্ত হইয়া বলে, তোমার কাছে অত কৈফিয়ত দিতে পারব না বউ।
কুসুম সগর্বে মাথা তুলিয়া বলে, কৈফিয়ত কেউ চায়নি আপনার কাছে। মুখ শুকনে দেখে মায়া হল, তাই জানতে এলাম অসুখবিসুখ হয়েছে না কি। সংসারে জানেন, ছোটোবাবু, যেচে মায়া করতে গেলে পদে পদে অপমান হতে হয়। আমি এদিকে চলে যাচ্ছি বাপের বাড়ি, কৈফিয়ত চাইব!
শশী নরম হইয়া বলে, গাঁয়ে এতবড় ব্যাপার ঘটছে, দেখা হলে ও-বিষয়ে তুমি কিছুই বলো না,—শুধু আমার তোমার নিজের কথা। বলবার কি আর কথা নেই জগতে?