কিছুতেই এ মতলব ছাড়বেন না পণ্ডিতমশায়?
তাই কী হয় শশী? বিশ বছর আগে থেকে এ যে ঠিক হয়ে আছে।
কই পাগলদিদি তো কিছু জানতেন না?
ওকে কি বলেছি যে জানবে? সময় এগিয়ে এসেছে তাই কথায় কথায় সেদিন তোমায় বললাম। নইলে একেবারে সেই যাবার দিন বলে বিদায় নিতাম।
পিছিয়েও দিতে পারেন? তাই বলুন না সকলকে? বলুন যে আপনার অনেক কাজ বাকি, তাই ভেবেচিন্তে দু-চার বছর পিছিয়ে দিলেন দিনটা?
কথাটা বোধ হয় যাদবের মনে লাগে। উৎসুক দৃষ্টিতে তিনি শশীর মুখের দিতে চাহিয়া থাকেন, শশীর মনে হয় একটি ফাঁদে-পড়া জীবন যেন হঠাৎ বেড়ার গায়ে ছোট একটি ফাঁক দেখিতে পাইয়াছে। তারপর আত্মসম্বরণ করিয়া যাদব মাথা নাড়েন।
লোকে হাসবে শশী, টিটকারি দেবে।
বলিয়া তাড়াতাড়ি যোগ দেন, সেজন্যও নয়। যোগসাধন করে যেসব শক্তি পাওয়া যায়, ভগবানের নিয়মকে ফাঁকি দেবার জন্য তার ব্যবহার নিষেধ শশী।
একে ওকে জিজ্ঞাসা করিয়া সারাদিনের চেষ্টায় শশী কিছু কিছু বুঝিতে পারিল, বিনা প্রতিবাদে যাদব কেন জনরবকে মানিয়া লাইয়াছেন। কথাটা ছড়াইয়াছিল পল্পবিত হইয়া। ভক্তদের মধ্যে অনেকে জানিত যাদব বহুদিন হইতে শশীকে শিষ্য করিবার চেষ্টা করিতেছেন, শশীর এ সৌভাগ্যে তাহারা হিংসা করিয়াছে। কাল কুসুম নাকি ব্যস্ত ও উত্তেজিতভাবে বলিয়া বেড়াইয়াছিল যে স্নান করিয়া পাগলদিদিকে সে একবার প্রণাম করিতে গিয়াছিল, স্বকৰ্ণে শুনিয়া আসিয়াছে রথের দিন মরিবেন বলিয়া তাড়াতাড়ি শিষ্যত্ব গ্রহণের জন্য শশীকে যাদব পীড়াপীড়ি করিতেছেন। এসব ছাড়া আরও অনেক কথাই রটিয়াছিল। তবু, তখনও জনরবটা অস্বীকার করিবার উপায় হয়তো থাকিত যাদবের। বাজিতপুরে যাওয়ার আগে শ্রীনাথকে শশী যা বলিয়া গিয়াছিল তাহাই যাদবের সবচেয়ে বড় বিপদের কারণ হইয়াছে। শশীর কথা সহজে লোকে অবিশ্বাস করে না। তা ছাড়া, যাদবের বিশেষ প্রিয়পাত্র বলিয়াই লোকে তাহাকে জানে। তবু, শশী গ্রামে থাকিলে যাদব হয়তো স্বীকার করিবার আগে তাহাকে ডাকিয়া পাঠাইতেন, বলিতেন, এরা কী বলছে শোনো শশী। কিন্তু তাকে পাওয়া যায় নাই। গ্রামে আলোড়ন তুলিয়া দিয়া সে চলিয়া গিয়াছিল, তারপর সারাজীবনের চেষ্টায় গড়িয়া তোলা মানুষের অস্বাভাবিক ভক্তি ক্ষুন্ন হইবার ভয়ে, খানিকটা এই ভক্তি বাড়ানোর লোভে যাদব জনমতের স্রোতে ভাসিয়া গিয়াছেন।
কীরকম হইয়াছিল শশী কিছু কিছু অনুমান করিতে পারে। রথের দিন মরিবার কথা শশীকে তিনি যাহা বলিয়াছিলেন সেকথা যাদবের স্মরণ ছিল। শশীর কথায় গ্রামের লোক কতখানি বিশ্বাস রাখে তাও তিনি মনে রাখিয়াছিলেন। শশী গ্রামে নাই শুনিয়া ভাবিয়াছিলেন, এখন যদি অস্বীকার করেন যে আগামী রথের দিন মরিবার কথা শশীকে বলেন নাই, শশী গ্রামে ফিরিবামাত্ৰ সকলে তাহাকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করবে। হয়তো ধৈর্য ধরিতে না পারিয়া কেহ বাজিতপুরে ছুটিয়া গিয়াও শশীর সঙ্গে দেখা করিয়া আসিবে। ব্যাপারটির গুরুত্ব শশী কিছু বুঝিতে পারবে না, একবার সে যা বলিয়াছে আবার সেই কথাই বলিবে। লোকে তখন মনে করিবে, হয় শশী মিথ্যাবাদী–নয় যাদব নিজে।
আরও কত কী হয়তো যাদব ভাবিয়াছিলেন। হয়তো জলরবের পিছনে কিরূপ এবং কতখানি শক্তি আছে বুঝিতে না পারিয়া যাদবের ভয় হইয়াছিল যে বিরোধিতা করিলে জীবন অপেক্ষা যাহা তার প্রিয় তাহা বিনষ্ট হইয়া যাইবে। হয়তো সমবেত মানুষগুলির উচ্ছ্বাস নেশার মতো আচ্ছন্ন করিয়া দিয়াছিল যাদবকে। ভাববার তাহার সময় থাকে নাই।
শশী কুসুমকে বলিল, মিথ্যে কথাগুলো বলে বেড়ালে কেন বউ?
কুসুম বলিল, বলতে কেমন ইচ্ছে হচ্ছিল ছোটোবাবু, তাই।
মাথাটা তোমার খারাপ নাকি সময় সময় তাই ভাবি বউ, অবাক মানুষ তুমি।
কয়েকটা দিন চলিয়া গেল। কলিযুগের ইচ্ছামৃত্যু মহাপুরুষ যাদবকে দেখিবার জন্য নিকট ও দূরবর্তী গ্রামের লোক কায়েতপাড়ার পথটিকে জনাকুল করিয়া রাখল। মুড়িচিড়া বেচিয়া শ্রীনাথ আর লোচন ময়রা বোধ হয় বড়লোকই হইয়া গেল। শ্রীনাথ দু হাতে মুড়ি-চিড়া বেচে, দু হাতে পয়সা লইয়া কাঠের বাক্সে রাখে, সর্বক্ষণ হায় হায় করে। কয়েক দিনে পাগলদিদি শীর্ণ হইয়া গেলেন। শশীর মনেও গুরুভার চাপিয়া আছে। রথের দিন কী হইবে সে বুঝিতে পারে না। সত্যই কি মনের জোরে যাদব সেদিন দেহত্যাগ করিতে পারবেন? এ যে বিশ্বাস করা যায় না। না মরিলেই বা যাদবের কী অবস্থা হইবে?
যেখানে যায় শশী, এই কথাই আলোচিত হইতে শুনিতে পায়। যাদব মরিবেন বলিয়া অনেকেরই আপসোস নাই, সংগ্রহে রথের দিনটির প্রতীক্ষা করিতেছে। শশীকে চুপ করিয়া থাকিতে হয়। মিথ্যার ভিত্তিতে যে এতবড় ব্যাপারটা গড়িয়াছে, মুখ ফুটিয়া প্রকাশ করিবার উপায় নাই। এই জনমতের উৎস সে, কিন্তু এ গুজবকে পরিবর্তিত করিবার ক্ষমতা তাহার নাই। এই অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হইতে শুকনো চালে আগুন ধরিয়াছে, কারো ক্ষমতা নাই আগুন নিভাইতে পারে। একটা অদ্ভুত অসহায়তার উপলব্ধি হয় শশীর। প্রাত্যহিক জীবনে যাদবের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক থাকে না মানুষের, তাদের সমবেত মতামত যে কতদূর অনিবার্য একটা অন্ধ নির্মম শক্তি হইয়া উঠিতে পারে, আজ সে তাহা প্রথম বুঝিতে পারে।
যাদবের বাড়ি গিয়া শশী বসে, যাদবের ভাব লক্ষ করে। মনে হয় কী একটা তীব্র নেশায় যাদব আচ্ছন্ন, অভিভূত হইয়া গিয়াছেন। ব্যাপারটা যেন তার কাছে ক্রমে ক্রমে পরম উপভোগ্য হইয়া উঠিতেছে। বিশ্রাম করিতে কিছুক্ষণের জন্য ভিতরে আসেন, তারপর আবার বাহিরে গিয়া দর্শনার্থীদের সামনে বসেন, মুখ দিয়া ফোয়ারার মতো ধর্ম ও দর্শন, যোগসাধনার কথা বাহির হয়,-সেসব অপূর্ব বাণী শুনিয়া শশী অবাক মানে। কী এক অত্যাশ্চর্য প্রেরণা যেন আসিয়াছে যাদবের। মুখের উপদেশ শুনিয়া অভিভূত হইয়া যাইতে হয়, এক অপরূপ আনন্দে অন্তর ভরিয়া যায়, এক অনায়ত্ত অধ্যাত্মজগতে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য ব্যাকুলতা জাগে অপরিসীম।