হায় সর্বনাশ। বলিয়া শ্ৰীনাথ আকুল হইয়া ছুটিয়া গেল।
ব্যাপারটা যে এত বিরাট হইয়া উঠিবে তখনো শশী কল্পনা করে নাই। নতুবা শ্রীনাথকে ডাকিয়া সে বলিয়া দিত যে রথের দিন যাদব দেহ রাখিবেন বলিয়াছেন বটে কিন্তু সে কোনও এক রথের দিন, আগামী রথ নয়। হাসপাতালে ভরতি করিয়া দিবার জন্য একটি কঠিন অপারেশন রোগীর সঙ্গে শশী বাজিতপুরে যাইতেছিল। রোগীটির অবস্থা বড় শোচনীয়। হাসপাতালে লইয়া যাওয়ার ব্যবস্থা দেওয়া উচিত হইয়া কি না, পথেই যদি শেষ হইয়া যায় তবে বড়ই দুঃখের কথা হইবে, এইসব ভাবিতে ভাবিতে শশী অন্যমনস্ক হইয়া গিয়াছিল।
বাজিতপুরের সরকারি ডাক্তারের সঙ্গে শশীর ঘনিষ্ঠতা হইয়াছিল। সম্প্রতি তিনি বদলি হইয়া যাইতেছেন। শশীকে সেদিন তিনি ফিরিতে দিলেন না। পরদিন গ্রামে ফিরিয়া কায়েতপাড়ার পথে লোকের ভিড় দেখিয়া শশী অবাক হইয়া গেল। যাদবের ভাঙা জীর্ণ বাড়ির সম্মুখে অনেক লোক জমিয়াছে। যাদব বাহিরে আসিয়া বসিয়াছেন, পদধূলির জন্য সকলে কাড়াকাড়ি করিতেছে। সজল কণ্ঠে শ্রীনাথ করিতেছে হায় হায়।
একজন শশীকে বলিল, সামনের রথের দিন পণ্ডিত মশায় দেহ রাখবেন ছোটোবাবু।
সামনের রথের দিন? কে বললে একথা? শ্ৰীমুখে নিজেই বলেছেন। দূর-গাঁ থেকে লোক আসছে ছোটোবাবু, খবর পেয়ে। শেতলবাবু এই মাত্তর ঘুরে গেলেন।
ওদিক দিয়া ঘুরিয়া শশী বাড়ির ভিতের গেল। মেয়েরা দল বাঁধিয়া আসিতে শুরু করিয়াছিল, পাগলদিদি দরজা খোলেন নাই। শশীর ডাকাডাকিতে দুয়ার খুলিয়া দিলেন, কাদিয়া বলিলেন, ও শশী, এমন সর্বনাশ কেন করলি আমার, কেন রটালি ও কথা?
শশী বিবর্ণমুখে বলিল, আমি তো ওকথা রটাইনি পাগলদিদি।
পাগলদিদি বলিলেন, একদল লোক সঙ্গে নিয়ে শ্রীনাথ এসে কেদে পড়ল শশী, বলল, তুই নাকি বলেছিস ওঁর নিজের মুখে শুনে গেলি এবার রথের দিন—
এবার রথের দিন? আমি তো বলিনি পাগলদিদি। পণ্ডিতমশায় স্বীকার করলেন?
পাগলদিদি সায় দিলেন।
শশী ব্যাকুল হইয়া বলিল, কেন তা করলেন? এ কী পাগলামি! পণ্ডিতমশায় বলতে পারলেন না এবারকার রথের কথা বলেননি?
কই তা বললেন? হাসিমুখে মেনে নিলেন। কী হবে এবার?
বাহিরের কলরব ভাসিয়া আসিতেছিল, শশী দরজাটা ভেজাইয়া দিল। সমস্ত ব্যাপারটা এমন দুর্বোধ্য মনে হইতেছিল শশীর যাদবের সম্বন্ধে এরকম একটা জনরব একেবারেই বিস্ময়কর নয়, মাঝে মাঝে তার সম্বন্ধে অনেক অস্তুত কথা রটে। যাদব সমর্থন করিলেন কেন? মাথা তো খারাপ নয় যাদবের, পাগল তো তিনি নন। একদল লোক সঙ্গে করিয়া শ্রীনাথ আসিয়া কাদিয়া পড়িল, অমনি কোনো কথা বিবেচনা না করিয়া যাদব স্বীকার করিয়া বসিলেন যে আগামী রথের দিন তিনি স্বেচ্ছায় মরিবেন? এরকম স্বীকারোক্তির ফলাফলটা একবার ভাবিয়া দেখিলেন না? কে জানে কী হইবে এবার রথের দিন যাদব যদি না মরেন, মানুষের কাছে মিথ্যাবাদী হইয়া থাকিতে হইবে তাকে; তার সিদ্ধিতে, তার শক্তিতে লোকের বিশ্বাস থাকিবে না,-যাদবের কাছে তাহা মৃত্যুর চেয়ে শতগুণে ভয়ংকর মানুষের অন্ধ ভক্তি ছাড়া বাঁচিয়া থাকিবার আর তো কোনো অবলম্বন তাহার নাই। একথা যাদব কেন স্বীকার করিয়া লইলেন? বলিলেই হইত এ শুধু জনরব, ভিত্তিহীন গুজব! যাদবের কথা কে অবিশ্বাস করিত রথের তো বেশিদিন বাকি নেই। সেদিন যাদব কেমন করিয়া মরিবেন? না মরিলে কেমন করিয়া মুখ দেখাইবেন গ্রামে?
অনেকক্ষণ পরে ক্লান্ত যাদব বিশ্রামের জন্য ভিতরে আসিলেন। কয়েকটি ভক্তও সঙ্গে সঙ্গে ভিতরে আসিতেছিল, রূঢ়ভাবে ধাক্কা দিয়া তাহাএর বাহির করিয়া করিয়া কানি সদর দরজা বন্ধ করিয়া দিল। ভিড়ে, গরমে যাদব ঘামিয়া বিবর্ণ হইয়া গিয়াছেন, পাগলদিদি তাড়াতাড়ি পাখা আনিয়া বাতাস করতে লাগিলেন ফোকলা মুখের চিরন্তন হসিটি তাঁহার নিভিয়া গিয়াছে। দুচোখ-ভরা জল–বার্ধক্যের স্তিমিত দুটি চোখ।
এ কী করলেন পণ্ডিতমশায়? স্বীকার করলেন কেন? ব্যাকুলভাবে শশী জিজ্ঞাসা করিল।
কেন করলাম? রথের দিন মরব যে আমি। বলিনি তোমাকে? শান্তভাবে জবাব দিলেন যাদব।
এবারকার রথের কথা তো বলেননি আমাকে?
বলেছিলাম বইকী। এবারকার রথের কথাই বলেছিলাম। তুমি এত বিচলিত হচ্ছ কেন শশী? আমার কাছে কী জীবন-মরণের ভেদ আছে? গুরুর কৃপায় সূর্যবিজ্ঞান যেদিন আয়ত্ত হল, যেদিন সিদ্ধিলাভ করলাম, ও-পার্থক্য সেদিন ঘুচে গেছে শশী। এমনি হিসাবও যদি ধরো, মরবার বয়েস কি আমার হয়নি?
শশী কাতর হইয়া বলিল, আমার জন্যই এ কাণ্ড হল। আমার যে কীরকম লাগছে পণ্ডিতমশায়–
যাদব হাসিয়া বলিলেন, বাসাংসি জীর্ণানি…
শশীর মনে পড়িতেছিল, সেদিন রাতের কথা। কলিকাতা-ফেরত যাদব শ্রীনাথের দোকান হইতে সাপের ভয়ে যেদিন লাঠি ঠুকিয়া ঠুকিয়া বাড়ি আসিয়াছিলেন। জীবনের সেই ভীরু মমতা কোথায় গেল যাদবের? কোথা হইতে আসিল মৃত্যু সম্বন্ধে এই প্রশান্ত ঔদাস্য? যাদবের সম্বন্ধে সে কি আগাগোড়া ভুল করিয়াছে? লোক যে অলৌকিক শক্তির কথা বলে সত্যই কি তা আছে যাদবের? খানকয়েক ডাক্তারি-বইপড়া বিদ্যায় হয়তো এসব ব্যাপারের বিচার চলে না, হয়তো তার অবিশ্বাস শুধু অজ্ঞানতার অন্ধকার!
অনেক যুক্তিতর্ক অনুরোধ উপরোধেও যাদবকে শশী কিছুঁতেই টলাইতে পারিল না। আগামী রথের কথা বলেন নাই, একথা কিছুঁতেই স্বীকার করিলেন না। শশী কোনো ক্ষতি করে নাই। কথাটা না রটিলে রথের দিন তিনি অবশ্যই দেহত্যাগ করিতেন। জনরব তুলিয়া দিয়া শশী যদি তার কোনো অসুবিধা করিয়া থাকে তা শুধু এই যে, লোক পদধূলির জন্য জ্বালাতন করিতেছে, আর কিছু নয়।