পাগলদিদি আম কাটিয়া দেন শশীকে, একটা খোলা পুঁথির সামনে বসিয়া স্থল শুভ্র উপবীতখানি যাদব আঙুলে জড়ান। দ্বিজত্বের এই চিহ্নটি শশী তাহার কখনও মলিন দেখিল না। শশীর দৃষ্টিপাতে যাদব হাসেন, পৈতে কখনও মাজি না শশী।
মাজেন না?
না। ও কাজের বরাত দিয়েছি সূর্যকে।
সূর্যকে? —শশী সবিস্ময়ে বলে।
যাদব গম্ভীর মুখে বলেন, সূর্যকে। সূর্যবিজ্ঞান বিশ্বাস করো না তাই অবাক হও, নইলে এ তো তুচ্ছ সূর্যজ্ঞিান যে জানে তার উপবীত কখনও ময়লা হতে পারে? কী করি জানো? স্নান করে উঠে রোজ একবার রোদে মেলে ধরি, ধবধবে সাদা হয়ে যায়। আজ খানিকটা বাদ পড়ে ছিল, কেমন ময়লা হয়ে আছে দ্যাখো—
যাদব পইতা মেলিয়া ধরেন, শশী লক্ষ করিয়া দ্যাখে রোদের পাশে ছায়ার মতো পৈতার খানিকটা সত্যসত্যই নিম্প্রভ, মলিন। সূর্যবিজ্ঞানে আর নিজের অত্যাশ্চর্য ক্ষমতায় শশীর বিশ্বাস জন্মানোর জন্য কত যত্নে না-জানি যাদব পৈতার ওই অংশটুকু পাতলা জল-মেশানো কালিতে ডুবাইয়াছেন, কালি যাতে বুঝা না যায়। শশীর হাসিও পায়, মায়াও হয়। তাকে অভিভূত করার জন্য এত ব্যাকুল প্রয়াস কেন যাদবের? অলৌকিক শক্তিতে অবিশ্বাস করিলেও যাদবকে শ্রদ্ধা সে তো কম করে না!
যাদব বলেন, কত বললাম, শেখো, শশী শেখো, সূর্যবিজ্ঞানের ভূমিকাটুক অন্তত শেখো, ওষুধের বাক্স ঘাড়ে করে রোগী দেখে বেড়াতে হবে না। তা তো শিখলে না। যে বিজ্ঞানের ভিত্তিই মিথ্যে তাই নিয়ে মেতে রইলে। যাকে-তাকে দেবার বিদ্যা এ তো নয়, সারাজীবনে একটি শিষ্য পেলাম না যাকে শিখিয়ে যেতে পারি। এদিকে সময় হয়ে এল যাবার। শুধু তুমি একটু শিখতে পারো শশী, সবটা নয়, সবটা নেবার ক্ষমতা তোমারও নেই, শুধু ভূমিকাটুকু। তাই বা কজনে পায়? কায়মনোবাক্যে আজও তুমি ব্রহ্মচারী বলে—
বিব্রত, বিস্মিত শশী শুনিয়া যায়। এ-ধরনের কথা যাদব মাঝে মাঝে বলেন, শশীও সায় দেয় না, প্রতিবাদও করে না। যাদবের শাস্ত ধূপগন্ধ ঘরে সে দুদণ্ডের জন্য জুড়াইতে আসে, তাকে এসব অবিশ্বাস্য কাহিনী শোনানো কেন? সে কি শ্রীনাথ মুদি যে শুনিতে শুনিতে গদগদ হইয়া মুখে ফেলা তুলিবে?
শশীর অবিশ্বাস যাদব টের পান। শশীকে জয় করিবার জন্য তার এত বেশি আগ্রহের কারণও বোধ হয় তাই।
বলেন, সূর্যবিজ্ঞান যে জানে, তার অসাধ্য কী? অতীত ভবিষ্যৎ তার নখদর্পণে। কবে কী ঘটিবে জীবনে কিছুই তাহার অজানা থাকে না। মৃত্যুর দিনটি পর্যন্ত দশ বিশ বছর আগে থেকে জেনে রাখতে পারে।
পৈতাটা যাদব আঙুলে জড়ান আর খোলেন। দুচোখ জ্বলজ্বল করে। সাধে কি ভীরু গ্রামবাসী ভয় করে যাদবকে এমন জ্যোতিষ্মান চোখে চাহিয়া এমন জোরের সঙ্গে যাই তিনি বলুন, অবিশ্বাস করিবার সাহস কারো হওয়া সম্ভব নয়।
আপনি জানেন? – শশী জিজ্ঞাস করে।
জানি না? বিশ বছর থেকে জানি।–বলেন যাদব।
হাসি পায় বলিয়া শশী ফস করিয়া জিজ্ঞাসা করিয়া বসে, কবে?
যাদবও সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়, রথের দিন। আমি রথের দিন মরব শশী। কবে কোন সালের রথের দিন যাদব দেহত্যাগ করবেন ঠিক হইয়া আছে, শশী আর সে কথা জিজ্ঞাসা করে না, কারণ কথাটা বলিয়াই যাদব হঠাৎ এমন ভীতভাবে স্তব্ধ হইয়া যায় এবং পাগলদিদি এমনভাবে অস্ফুট একটা শব্দ করিয়া ওঠেন যে শশী লজ্জবোধ করে। অবিশ্বাসের পীড়নে উত্তেজিত করিয়া অমন অসাবধানে যাদবকে ওকথা বলানো তাহার উচিত হয় নাই। আর ছ’মাস এক বছরের বেশি গ্রামে শশী থাকিবে না একথা যাদব জানেন। তবু, তার মধ্যেই অসুখ-বিসুখ হইয়া যদি তিনি মরিতে বসেন আর শশীকেই তার চিকিৎসা করিতে আসিতে হয়, মরিতেও বেচারির সুখ থাকিবে না!
কথাটা চাপা দিবার জন্য শশী অন্য কথা পাড়ে। বলে, জানেন পণ্ডিতমশায়, চলে আমি যাব ঠিক, কিন্তু কেমন ভয় হয় মাঝে মাঝে। শুধু শহরে গিয়ে ডাক্তারি করার ইচ্ছা থাকলে কোনো কথা ছিল না, এত বড় বড় কথা আমি ভাবি! বিদেশে যাব, ফিরে এসে কলকাতায় বসব, মানুষের শরীর আর মনের রোগ সম্বন্ধে নতুন নতুন গবেষণা করব, দেশ-বিদেশে নাম হবে, টাকা হবে–।
যাদব যেমন করিয়া সূর্যবিজ্ঞানের কথা বলতেছিলেন, তেমনিভাবে শশী এবার নিজের কল্পনার কথা বলে।
সেই হল সূত্রপাত। রথের দিন দেহত্যাগ করিবার কথা যাদব যা বলিয়াছিলেন শশী জানে তা নেহাত কথার কথা, হঠাৎ মুখ দিয়া বাহির হইয়াছে। হারু ঘোষের বাড়ি গিয়া কথায় কথায় পরাণের কাছে এ গল্প সে কেন করিয়াছিল শশী জানে না। বোধ হয় কুসুমকে শোনানোর জন্য। যেখানে যা-কিছু বিচিত্র ব্যাপার সে প্রত্যক্ষ করে, পরাণকে বলিবার ছলে কুসুমকে সেসব শোনানোর কেমন একটা অভ্যাস তাহার জন্মিয়া যাইতেছে।
তারপর কেমন করিয়া কথাটা যে ছড়াইয়া গেল! ছড়াইয়া গেল একেবারে দিগদিগন্তে। ঝোঁকের মাথায় শশীর কাছে যাদব যে অর্থহীন কথাটা বলিয়াছিলেন গ্রামে তাহা এমন আলোড়ন তুলিবে কে জানিত।
শশী বাজিতপুরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হইতেছিল, ছুটিয়া আসিল শ্ৰীনাথ। সত্যি ছোটোবাবু, দেবতা দেহ রাখবেন?
শশী বলিল, তুমি কী পাগল শ্রীনাথ? কথার ছলে কি বলেছেন না বলেছেন–
শ্রীনাথ বলিল, কথার ছলে তো বলছেন ছোটোবাবু, নইলে নিজে কী রটিয়ে বেড়াবে শুধু এই কথাটি আপনি বলেন ছোটোবাবু, নিজের মুখে দেবতা উচ্চারণ করেছেন কি রথের দিন দেহ রাখবেন?
শশী বলিল, বলেছেন বটে, কিন্তু কী জান–