শশী বলিল, তোমার মুখে এসব কথা হয়তো ঠাট্টার মতোই শোনায় নন্দ।
নন্দর ভাবপ্রবণতা ভাঙিয়া গেল। মুখে দেখা দিল মেঘের মতো বিরাগের ছায়া। হাতের নল নামাইয়া, চোখের ভুরু কুচকাইয়া সে বলিল, তুমি যদি পরিহাস করতে এসে থাকো–
পরিহাস? তোমার সঙ্গে? এরকম কান্ডজ্ঞানের অভাব না হলে তুমি এমন সব কাণ্ড করতে পারো!
শশী আর বসিল না। তাঁহাকে আগাইয়া দিতে নন্দ উঠিয়া আসিল না, যে চা ও খাবার শশী স্পর্শ করে নাই সেদিকে চাহিয়া কী যেন ভাবিতে লাগিল।
গ্রামে ফিরিয়া দিনগুলি এবার অপ্রীতিকর মানসিক চাঞ্চল্যের মধ্যে কাটিতে থাকে। গরমে শরীরও কিছু খারাপ হইয়া যায় শশীর। এ বছর একেবারে বৃষ্টি নাই। গ্রামের শ্যামল রূপ রোদে পুড়িয়া একেবারে বাদামি হইয়া উঠিয়াছে। এটা কলেরার মরসুমের সময়, শ্মশানে ধুম লাগিয়াই আছে। বেশি খাঁটিতে হওয়ায় শশীর মেজাজ গিয়াছে আরও বিগড়াইয়া। স্নানাহারের সময় পায় না, অথচ তেমন পয়সা নাই। কলিকাতায় এরকম পশার হইলে এতদিনে সে বোধ হয় লাখপতি হইয়া যাইত।
পরাণ আশা করিয়াছিল কলিকাতা হইতে শশী তাহাকে মতির খবর আনিয়া দিবে। শশী ফিরিয়াছে শুনিবামাত্র সে ছুটিয়া আসিয়াছিল। শশী মুখ তুলিয়া চাহিতে পারে নাই। পরাণও চুপচাপ খানিক বসিয়া থাকিয়া উঠিয়া গিয়াছিল। সেটা সকাল। তারপর দুপুরে আসিয়াছিল কুসুম। বলিয়াছিল, কেন যে মরছে ভেবে ভেবে চুরি করে তো আর নিয়ে যায়নি বোনকে কেউ, সে গেছে সোয়ামির সঙ্গে, অত ভাবনা কিসের দিনরাত? —কী আনলেন আমার জন্যে?
তোমার জন্যে? কিছু আনিনি বউ।
কী ভুলো মন মাগো কত করে যে বলে দিলাম আনতে?
শশী অবাক হইয়া বলিয়াছিল, কী আবার আনতে বললে তুমি? কখন বললে?
ওমা, বলিলি বুঝি? তা হবে হয়তো বলব বলে বলিনি শেষ পর্যন্ত? কিন্তু না বললে কি আনতে নেই?
কী অকৃত্রিম ছেলেমানুষি কুসুমের, কী নির্মল হাসি তারপর কয়েকদিন কুসুমের সঙ্গে দেখা হয় নাই, এই হাসি শশীর মনে ছিল। জোর করিয়া মনে রাখিয়াছিল। ভাপসা গুমোট, শুষ্ক ডোবা-পুকুর-ভরা গ্রামের রুক্ষ মূর্তি আর কলেরা রোগীর কদর্য সান্নিধ্য, এই সমস্ত পীড়নের মধ্যে কুসুমের খাপছাড়া হাসিটুকু ভিন্ন মনে করিবার মতো আর কিছু শশী খুঁজিয়া পায় নাই।
কিছু ভালো লাগে না শশীর,-নাগ্রাম, না গ্রামের মানুষ। শেষরাত্রে টেকির শব্দে ঘুম ভাঙিয়া যায়। তখন হইতে সন্ধ্যার নীরবতা আসিবার আগে কায়েতপাড়ার পথের ধারে বটগাছটার শাখায় জমায়েত পাখির কলরব শুরু হওয়া পর্যন্ত, বন্য ও গৃহস্থ জীবনের যত বিচিত্র শব্দ শশীর কানে আসে, সব যেন ঢাকিয়া যায় যামিনীর হামানদিস্তার ঠকঠক শব্দে আর গোপলের গম্ভীর কাশির আওয়াজে। বাড়িতে মেয়ে-পুরুষ হাসে কাঁদে কলহ করে, বাহিরে যুবক ও বৃদ্ধের দল তাস খেলে আড্ডা দেয়, চাষি মজুর গয়লা কুমোর স্যাকরা জেলে দোকানি এরা ছাড়া অলস অকৰ্মণ্যতার অতিরিক্ত ভদ্র পেশা যাদের আছে আঙুলে গুনিয়া ফেলা যায়। শ্রীনাথের দোকানের লালচে আলোর কীর্তি নিয়োগীর মাথার তেলমাখা আবটি চকচক করিতে দেখিলে নৈশ আকাশের তারা ও চাঁদের আলোর দিকে চাহিতে শশীর লজ্জা করে! বাগদীপাড়ায় জেলফেরত কয়েকজন বীরপুরুষ রাতদুপুরে পরস্পরের মাথা ফাটাইয়া দেয়, শশীর হাতের বাধা ব্যান্ডেজ তাহাদের খোলা হয় জেলের হাসপাতালে। সুদেব বলিয়া বেড়ায়, মতির বিবাহটা মিছে, ছল—শশী কর্তৃক মতিকে গাপ করার কৌশল মাত্র।–ভদ্দরপানা যার সঙ্গে বিয়ে হয় মতির কত টাকা সে খেয়েছে জানো ছোটোবাবুর ঠেয়ে? হয়তো বাজিতপুরে হয়তো আর কোথাও মতিকে শশী লুকাইয়া রাখিয়াছে,–গাঁয়ে যে শশী থাকে না, রোগী দেখিবার ছলে কোথায় চলিয়া যায়, সুদেব ছাড়া আর কে তার অর্থ বুঝিবে! অন্ধকার রাত্রে গোয়ালপাড়ার আট-দশটা ছোকরা একদিন দু-তিন গামলা গোবর-গোলা জল শশীর গায়ে ঢালিয়া দেয়,–গোয়ালপাড়ার গোবর অতি সুপ্রাপ্য। পরদিন গোপালের গোমস্তা বাকি টাকার জন্য সদরে নালিশ রুজু করিতে গিয়াছে খবর পাইয়া গোয়ালপাড়ার মোড়ল বিপিন অবশ্য আসিয়া কাদিয়া পড়ে,-গোটাকয়েক নিরীহ ছোকরাকে ধরিয়া আয়িা কান মলায়, নাকে খত দেওয়ায়। তাতে মন শান্ত হওয়ার কথা নয়।
তারপর আছে সেনদিদি। অন্ধকারে চোখের মতো পলায়নপর অবস্থায় সামনে পড়িয়া থমকিয়া দাঁড়ানো যেন আজকাল তার বিশেস একটা প্রিয় অভিনয়ে দাঁড়াইয়া গিয়াছে। অদূরে হ্রকার লাল আগুন হঠাৎ কোথায় অদৃশ্য হয়, খানিক পরে অন্দরে শোনা যায় গোপালের গলা।
সেনদিদি নূতন একটা আব্দার আরম্ভ করিয়াছে শশীর কাছে। গ্রামের একটি বৃদ্ধের চোখের ছানি কাটিয়া শশী সম্প্রতি তাহার দৃষ্টিশক্তি ফিরাইয়া আনিয়াছে। সেই হইতে সেনদিদি তাহাকে রেহাই দেয় না। বলে, ও শশী, দাও বাবা দাও, কেটে-কুটে ওষুধ দিয়ে যেমন করে হোক, দাও চোখটা আমার সারিয়ে।
শশী বলে, চোখ আপনার নষ্ট হয়ে গেছে সেনদিদি, ও আর সারবে না।
সেনদিদি ব্যাকুল হইয়া বলে, তুমি কেটে-কুটে দিলেই সারবে শশী, আমি তো জন্মান্ধ নই, অ্যাঁ? আমার জন্যে তোমার এত মায়া ছিল সেসব কোথায় গেল বাবা?
সেনদিদিকে বোঝানো দায়। কিছুই সে বুঝতে চায় না। শশীর হাতে চাপিয়া ধরিয়া কাদিয়া ফেলে—সবাই কানী বলে, আমার তা সয় না শশী। ওরে বাপরে, আমি কানি!
নিরূপায় শশী ভাবিয়া চিন্তিয়া বলে, কাচের চোখ নেবেন সেনদিদি, নকল চোখ? দেখতে অবশ্য পাবেন না চোখে, তবে চোখটা আপনার আসল চোখের মতো দেখাবে, লোকে সহজে টের পাবে না।