বিস্ময়ে ও আবেগে অধিকারী শুধু মাথাই নাড়িল খানিকক্ষণ। তারপর আরও বেশি অন্তরঙ্গ হইয়া বলিল, আপনাকে খুলেই বলি দাদা, কুমুদ গিয়ে থেকে দলটা কানা হয়ে গেছে। খাসা পার্ট বলত, বিশ বছর আছি এ লাইলে, অমনটি আর দেখিনি। দেখা হলে বলবেন, টাকা গেছে যাক, আসুক, কাজ করুক, পুরোনো কাসুন্দি ঘাটাবার পাত্র অধর মল্লিক নয়। দশ-বিশ টাকা মাইনে বেশি চায়, আমি কি বলেছি দেব না? ছোঁড়াটা কী!
দিন তিনেক শশী আরও কয়েকটা দলে কুমুদের খোঁজ করিল, কোনো সন্ধান পাওয়া যায় না। অনেক রোগী ফেলিয়া আসিয়াছে, বেশিদিন কলিকাতায় বসিয়া থাকিবার উপায় শশীর ছিল না। পরদিন সে গাওদিয়া ফিরিয়া যাইবে ঠিক করিল। বাকি জীবনটা কলিকাতায় বসিয়া মতির খোঁজ করিলে তো তার চলিবে না। গ্রামে ফিরিবার এই আভ্যন্তরিক তাগিদ সেদিন রাত্রে শশীকে একটু অবাক করিয়া দিল। শশীর ঘরখানা রাস্তার উপরে। অনেক রাত্রে চৌকির প্রান্তে জানালার ধারে সে বসিয়া ছিল। পথে তখন লোক চলাচল কমিয়াছে, দোকানপাট বন্ধ হইয়াছে। কাল তাহাকে গ্রামে ফিরিতে হইবে। একদিন গ্রাম ছাড়িয়া আসিয়া বৃহত্তর বিস্তৃততর জীবন গঠনের কল্পনা করিয়া সে দিন কাটায়, আর ইতিমধ্যেই এমন অবস্থা দাঁড়াইয়াছে যে এক সপ্তাহ বাহিরে আসিয়া তাহার থাকা চলেনা। কলেরা, বসন্ত, কালাজ্বর, টাইফয়েড এবং আরও অনেক ছোট-বড় রোগে আক্রান্ত যাদের সে ফেলিয়া আসিয়াছে, একে একে তাদের কথা মনে পড়িলে আর একটা দিনও অকারণে কলিকাতায় বসিয়া থাকিবার সংকল্পে নিজেকে তাহার খেয়ালি, বর্বর মনে হইতেছে। কে জানে ওদের কে ইতিমধ্যেই গিয়াছে মরিয়া, কার অবস্থা গিয়াছে খারাপের দিকে ফিরিয়া গিয়া আবার ওদের রোগশয্যা পার্শ্বে বসিতে না পারিলে মনে তো স্বস্তি পাইবে না। এ কী বন্ধন, এ কী দাসত্ব?
শশীর রাগ হয়। এ দায়িত্ব সে মানিবে না, এত কিসের নীতিজ্ঞান? গ্রামে তো সে ফিরিবে না এক মাসের মধ্যে-সে কি মানুষের জীবন-মরণের মালিক? যতদিন গ্রামে ছিল, যে ডাকিয়াছে চিকিৎসা করিয়া আসিয়াছে এখন যদি রোগীরা তার চিকিৎসার অভাবে মরিয়া যায়, মরুক। তিন বছর আগে সে ডাক্তারি পাস করে নাই, তখন কী করিয়াছিল গাঁয়ের লোক? এখনো তাই করুক। শশী কিছু জানে না।
০৮. গ্রামে না-ফিরিবার প্রতিজ্ঞা
এক মাস গ্রামে না-ফিরিবার প্রতিজ্ঞা দুদিনের বেশি টিকিল না শশীর। এ-গাঁয়ে ও-গাঁয়ে অসহায় বিপন্ন রোগীরা যে পথ চাহিয়া আছে।
বিন্দুর সঙ্গে দেখা করিবার ইচ্ছা শশীর আর ছিল না। রওনা হওয়ার দিন বিকালে হঠাৎ অনিচ্ছা জয় করিয়া সে হাজির হইল নন্দও বাড়িতে। নন্দ বাড়ি ছিল। বিন্দু? না, বিন্দুকে এখনো এ-বাড়িতে আনা হয় নাই।
নন্দ বলিল, ও বাড়ি যাব বলে তৈরি হচ্ছিলাম। দেখা করবে তো চলো আমার সঙ্গে।
শশী বলিল, ও বাড়ি যাবার সময় হবে না নন্দ। আজ বাড়ি যাচ্ছি, সাতটায় গাড়ি।
আজকেই যাবে? বোসো, চা-টা খাও।
শশীর মনে কি এ আশা ছিল যে গাওদিয়ার বাড়িতে টিকিতে না পারিলেও নন্দর গৃহে গৃহিণী হইয়া বিন্দু থাকিতে পারবে? বিন্দু আসে নাই শুনিয়া সে যেন বড় দমিয়া গেল। নন্দর বাড়িঘর দেখিয়া সে একটু অবাক হইয়া গিয়াছিল। এখানে আগে সে কখনও আনে নাই, নন্দর গৃহে বনেদিত্বের ছাপ যে এত স্পষ্ট ও প্রীতিকর এ ধারণা তাহার ছিল না। সেকেলে ধরনের ভারী নিরেট সব আসবাব, দরজা জানলায় দামি পুরু পর্দা, দেয়ালে প্রকাণ্ড কয়েকটা অয়েলপেন্টিং, এমনি সব গৃহসজ্জা নন্দর এই ঘরখানাকে একটি অপূর্ব গম্ভীর শ্রী দিয়াছে। অন্দর বোধহয় বেশি তফাতে নয়—কোমল গলার কথা ও হাসি শশীর কানে আসিতেছিল,—সে অনুভব করিতেছিল অন্তরালে একটি বৃহৎ সুখী পরিবারের অস্তিত্ব। তারপর একসময় সাত-আট-বছর বয়সের একটি সুশ্ৰী ছেলে কী বলিতে আসিয়া শশীকে দেখিয়া নন্দর গা ঘেষিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল। কী সুন্দর তার দুটি কৌতুহলী চোখ। আর কী মায়া নন্দর চোখে।
গরমে যে ঘেমে উঠেছিস? বলিয়া নন্দ নিজে ছেলের জামা খুলিয়া দিতে শশী যেন অবাক হইয়া গেল। একি অসঙ্গতি নন্দ ও নন্দর আবেষ্টনীর মধ্যে? তার এই পুরুষানুক্রমিক নীড়ে শাস্তি আছে নাকি? এই গৃহের সীমাবদ্ধ জগতে কি সুখ ও আনন্দের তরঙ্গ ওঠে আর পড়ে?
নন্দর ছেলে চলিয়া গেলে শশী বলিল, বিন্দুকে বলেছিলে নন্দ, এখানে আসার কথা?
বলেছিলাম। সে আসবে না।
আসবে না? ইহা অপ্রত্যাশিত নয়। তবু শশী যেন নিভিয়া গেল।
চাকর তামাক দিয়া গিয়াছিল, নন্দর হাতের নলটা সাপের মতো দুলিয়া উঠিল, অন্যমনস্কভাবে সে বলিতে লাগিল, এমন জেদি মানুষ জন্মে দেখিনি শশী কথা বললে হেসে উড়িয়ে দেয়। রাগের মাথায় ঠিক থাকেনি দিকবিদিক,-কিন্তু সত্যি বলছি শশী, শেষের দিকে ওই আমাকে চালিয়ে নিয়ে এসেছে, থামতে দেয়নি। স্পষ্ট করে আমি অবশ্য এতদিন বলিনি কিছু মনটা আমার কদুর বদলে গেছে আগে ভালো বুঝতে পারিনি শশী। এবার যখন গাওদিয়া চলে গেল সেই থেকে কেমন—
নন্দ হেন লোক, সেও আজ তামাক টানার ছলে কাশিল।
এখানে আনবার জন্য কত তোশামোদ করছি, কী আর বলব তোমাকে। কত বলছি যে আর কেন, চলো এবার ও-বাড়িতে, সকলের সঙ্গে মিলেমিশে থাকবে-খোকার মা আজ এক বছর শয্যাশায়ী, তার ভালোমন্দ কিছু হলে এতবড় সংসার তো তোমারি। না, আমি আর একটা বিয়ে করতে যাব এই বয়েসে। তা শুনে এমন করে হাসে যেন ঠাট্টা করছি।