পরদিন বিন্দুকে সঙ্গে করিয়া শশী কলিকাতায় রওনা হইয়া গেল। দিন এবং রাত্রি কাটিল পথে, কথা তাহারা বলিল খুব কম। কে ভাবিয়াছিল এ ভাবে বিন্দুকে আবার ফিরাইয়া দিতে হইবে। বিন্দুর বাড়ির সেই ফরাশ-পাতা, তবলা তাকিয়া ও কুদৃশ্য ছবিতে সাজানো ঘরখানা শশীর মনে ভাসিয়া উঠিতেছিল। সে ভাবিতেছিল, তার আলমারিতে বোতলের পাশে লেবেল-আঁটা বিষের শিশি ছিল, বিন্দু কেন বিষ খাইল না?
বেলা প্রায় দশটার সময় তাহারা বিন্দুর বাড়ি পৌঁছিল। দারোয়ান খুব ঘটা করিয়া সেলাম করিল বিন্দুকে, বিন্দুর দাসী একগাল হাসিল। নন্দ নামিয়া আসিল, নির্লজ্জ অকুণ্ঠ নন্দ। হাসিমুখে শশীকে অভ্যর্থনা করিয়া সে বলিল, এসো এসো, আসতে আজ্ঞা হোক।
শশী বলিল, আসতে পারব না নন্দ। কাজ আছে।
বিন্দু মিনতি করিয়া বলিল, একটু বসে যাবে না দাদা?
কাজ আছে বিন্দু।
শশী নামিয়া দাঁড়াইয়াছিল, এবার গাড়িতে উঠিয়া বসিল। বিন্দু তাকে আর নামিতে অনুরোধ করিল না, শুধু বলিল, গাঁয়ে ফেরার আগে যদি সময় পাও, একবারটি খবর নিয়ে যেও।
বিন্দু ভিতরে চলিয়া গেল। শশীর গাড়ি চলিতে আরম্ভ করিবে, গাড়োয়ানকে থামিতে বলিয়া নন্দ কাছে আগাইয়া আসিল। শশীর মনে হইল নন্দ খুব রোগা হইয়া গিয়াছে, গিয়াছে, চোখে রাতজাগার চিহ্ন।
খবর নিতে বোধ হয় আসবে না?—নন্দ জিজ্ঞাসা করিল।
কী করে বলি? সময় পাব না হয়তো।—বলিল শশী।
নন্দ একটু ভাবিল, এলে ভালো করতে শশী। ওকে কাল বাড়ি নিয়ে যাব ভাবছি— মা ওরা সব যে বাড়িতে আছেন সেইখানে। এ বাড়িটা বেচে দেব। নতুন লোকের মধ্যে গিয়ে পড়ে একটু হয়তো বিব্রত হয়ে পড়বে, তুমি গিয়ে দেখা করলে ভালো লাগবে ওর। মন বসতে সাহায্য হবে।
শশী অবাক হইয়া বলিল, বিন্দুকে বাড়ি নিয়ে যাবে?
নন্দ বলিল, তাই ভাবছিলাম। এখানে যখন থাকতে চায় না, বাড়িই চলুক। একবার তোমার সঙ্গে চলে গেল, পরের বার যদি জন্মের মতো আমাকে ত্যাগ করে বসে? কী জানো শশী, বুড়োবয়সে এসব হাঙ্গামা ভালো লাগে না। এখানে নিজের মনে কত আরামে ছিল,-ভিড় নেই, ঝঞ্ঝাট নেই, সব বিষয়ে স্বাধীন। তা যদি ভালো না লাগে, চলুক তবে যেখানে থাকতে ভালো লাগবে সেইখানে—আমার কী? আমি কাজের মানুষ, কাজ নিয়ে থাকি নিজের।
এ সুবুদ্ধি তোমার আগে হল না কেন নন্দ?
নন্দ হঠাৎ একথার জবাব দিতে পারিল না। তারপর ছেলেমানুষের মতো বলিল, আগে কী করে জানব যে পালিয়ে যাবে? বেশ তো হাসিখুশি দেখতাম।
শশী একবার ভাবিল, নন্দকে বুঝাইয়া এ মতলব ত্যাগ করিতে বলে। সাত বছর ধরিয়া যে অন্যায় সে করিয়াছে, আজ অসময়ে কেন তার প্রতিকারের চেষ্টা? চেষ্টা সফল হইবার সম্ভাবনাও নাই। ঘোমটা টানিয়া বিন্দু আজ এতকাল পারে শাশুড়ি ননদ সতিনের সংসারে নিরীহ বধূটি সাজিতে পারবে কেন? তা যদি পরিত, গাওদিয়ার উত্তেজনাহীন সহজ জীবন তাহার অসহ্য হইয়া উঠিত না।
শেষ পর্যন্ত কিছু না-বলাই শশী মনে করিল। নন্দর সঙ্গে এ আলোচনা করা চলে না।
গতবার কুসুমদের সঙ্গে করিয়া যে হোটেলে উঠিয়াছিল এবারও শশী সেইখানে গেল। কুমুদের দেখা পাইবার আশায় মতি যে এখানে আগ্রহে ব্যাকুল হইয়া উঠিয়াছিল সেকথা শশীর মনে আছে। মতি? অতটুকু মেয়ে মতি? কী মন্ত্রই কুমুদ জানে, বেহিসাবী নিষ্ঠুর যাযাবর কুমুদ!
পরদিন শশী কুমুদের খোঁজ করিল। একটা থিয়েটারের সাজপোশাকের দোকানে বিনোদিনী অপেরার ঠিকানা পাওয়া গেল, সরস্বতী অপেরার সন্ধান কেহ শশীকে দিতে পারিল না। কুমুদ বলিয়াছিল, বিনোদিনী অপেরার সঙ্গে তাহার সম্পর্ক চুকিয়াছে, ওখানে খোঁজ করিয়া লাভ হইবে কি না সন্দেহ। তবু শশী শেষবেলায় চিৎপুরে একটা বাড়ির দোতলায় অধিকারীর সঙ্গে দেখা করিল।
সদ্য-ঘুম-ভাঙা অধিকারী বলিল, কুমুদ? অঘ্রাণ মাস থেকে সে শালাকে আমরাও খুঁজছি মশায়। ভাওতা দিয়ে তিন মাসের মাইনে আগাম নিয়ে সরেছে। দুদিন পরে শ্রীপুরে রাজবাড়িতে বায়না ছিল, একেবারে ডুবিয়ে দিয়ে গেছে মশায়। অধিকারী আরক্ত চোখে কটমট করিয়া শশীর দিকে চাহিল, মশায়ের কী সর্বনাশটা করেছে শুনতে পাই?
শশী একটু হাসিল, সে কথা শুনে আর কী হবে? সরস্বতী অপেরার ঠিকানাটা বলতে পারেন?
সরস্বতী অপেরা? নামও শুনিনি।
এইখানে তবে ইতি কুমুদকে খোঁজ করার? শশী চলিয়া আসিতেছিল, অধিকারী বলিল, কুমুদের সঙ্গে আপনার দেখা হবে কি?
শশী বলিল, তা বলতে পারি না। হওয়া সম্ভব।
অধিকারী বলিল, দেখা হলে একবার জিজ্ঞেস করবেন তো এই কি ভদরলোকের ছেলের কাজ? আচ্ছা থাক, ওসব কিছু জিজ্ঞেস করে কাজ নেই, বাবুর আবার অপমানজ্ঞানটি টনটনে বলবেন যে আধর মল্পিক ও দুশো-চারশো টাকার জন্য কেয়ার করে না। পালাবার কী দরকার ছিল রে বাপু, অ্যাঁ? চাইলে ও কটা টাকা তোকে আর আমি দিতাম না,–তিন বছর তুই আমার দলে আছিল, ছেলের মতো তোর পরে মায়া বসেছে।
গলাটা অধিকারীর ধরিয়া আসিল, কে জানে শ্লেষ্মায় কি মমতার চোখ পিটপিট করিয়া বলি, আমার ছেলেপিলে নেই, জানেন? একটা মেয়ে ছিল, বাপ বটে আমি, তবু বলি দেখতে-শুনতে মেয়ের আমার তুলনা ছিল না মশায়-রঙ যাকে বলে আসল গৌর তাই। কুমুদের সঙ্গে বিয়ে দেব ভেবেছিলাম, তা ছোড়ার কি আর বিয়ে-টিয়ের মতলব আছে-একদম পাষণ্ড। তাই না কেষ্টনগরের এক ডাকাতের হাতে মেয়ে দিতে হল, যন্ত্রণা দিয়ে মেয়েটাকে তারা মেরে ফেললে। সেই থেকে কী যে হল আমার, সংসারে আর মন নেই-দল একটা করেছি, কেউ ডাকলে-ডুকলে পালা গেয়ে আসি-কিছু ভালো লাগে না মশায়। আছি শতেক জ্বালায় আধমরা হয়ে, কুমুদ ছোড়া কিনা ডুবিয়ে গেল আমাকেই,-ছোড়ার দেহে একফোঁটা মায়াদয়া নেই। আমি হলে তো পারতাম না বাপু একটা শোকাতুর মানুষের ঘাড় ভেঙে পালাতে,–পারতাম না। ছোঁড়াটা কী!