বিন্দু কাঁদিয়া বলে, না দাদা, দাও ঘুমের ওষুধ,-এত কষ্ট সইতে পারি না।
নিশুতি রাতে তাহার শীর্ণ কম্পিত শরীর আর জ্বলজ্বলে চোখের গাঢ় তৃষ্ণ শশীকে উতলা করিয়া তোলে। বুঝাইয়া সে পারিয়া ওঠে না। বিন্দু কোনো কথা কানে তোলে না-অবুঝ শিশুর মতো ঘুমের ওষুধ চাহিতে থাকে।
শশী বলে, তোর একটু মনের জোর নেই বিন্দু?
বিন্দু বলে, মরে গেলাম আমি, মনের জোর কোথা পাব?
শশী একটা ওষুধ তৈরি করিয়া তাকে দেয়। বিন্দু সে ওষুধ মেঝেতে ঢালিয়া ফেলে। শশীর পা জড়াইয়া ধরিয়া বলে, একটু ভালো ওষুধ দাও, একটুখানি দাও। দাও না একটু ভালো ওষুধ আমাকে?
ব্রান্ডির বোতল শশী বাক্সে বন্ধ করিয়া রাখিয়াছিল,–আলমারিতে রাখিতে সাহস পায় নাই। চাবির অভাবে কাচ ভাঙিয়া বোতলটা আয়ত্ত করা বিন্দুর পক্ষে অসম্ভব নয়। খানিকক্ষণ সে অবুলষ্ঠিতা বিন্দুর দিকে চাহিয়া থাকে। তারপর বলে, পা ছাড়, দিচ্ছি।
ওষুধের গ্লাসে ঘুমের ওষুধ খাইয়া বিন্দু ঘুমাইতে যায়। শশী চুপ করিয়া জাগিয়া বসিয়া থাকে। কত যে মশা কামড়ায় তাহাকে তাহার ইয়ত্তা নাই। শশী ভাবে, কেন সে এমন অক্ষম, এত অসহায়? শান্তি দিবে বলিয়া যাকে সে কুড়াইয়া আনিয়াছিল, রাতদুপুরে তাকে তার মদ পরিবেশন করিতে হয় কেন?
দিন-দশেক কলিকাতায় থাকিয়া গোপাল ফিরিয়া আসিল। বিন্দুর সম্বন্ধে সে আর কোনো উচ্চবাচ্য করিল না, মনে হইল বিন্দুর সেদিনকার অপরাধ সে বুঝি ক্ষমাই করিয়া ফেলিয়াছে। শশী তাহাকে চিনিত, গোপালের শান্তভাবে সেই শুধু একটু চিন্তিত হইয়া রহিল।
দিন-তিনেক নির্বিবাদে কাটিয়া গেল। তারপর একদিন সকালে শশীকে ভাকিয়া গোপাল বলিল, নন্দর সঙ্গে দেখা হয়েছিল শশী।
দেখা হইয়াছিল হঠাৎ, পথে!—গোপাল যাচিয়া দেখা করে নাই। গোপালের মানসিক প্রক্রিয়াটা ধরিতে না পারিয়া শশী একটু বিরক্ত হইয়া উঠিল।
বিন্দু অনেক দিন এসেছে, নন্দ ওদিকে রাগারগি করছে শশী,—দু-চার দিনের মধ্যে পাঠিয়ে দিতে বললে।
শশী স্পষ্ট জিজ্ঞাসা করিল, পাঠিয়ে দিতে বললে না আপনি কথার ভাবে অনুমান করলেন?
গোপাল জোর দিয়া বলিল, বললে, পাঠিয়ে দিতে বললে। তুমি ওকে রেখে আসতে পারবে?
শশী বলিল, পারব।
কাল দিন ভালো আছে, কালকেই রওনা হয়ে যাও।
তাই হোক। যাইতে যদি হয় বিন্দুকে, কাল গেলে কোনো ক্ষতি নাই। বিন্দুকে শশী কথাটা তখনি শুনাইয়া দিল। বিন্দু একটু হাসিল।
তাই চলো দাদা, সেই ভালো।
শশী বলিল, এমন জানলে তোকে আমি আনতাম না বিন্দু। শুধু কষ্ট পেলি, ওদিকে নন্দ রেগে রইল, কোনো লাভ হল না।
বিন্দু বলিল, লাভ হল বইকী দাদা চলে না এলে কী করে বুঝতাম ওখানে ওমনিভাবে থাকা ছাড়া আমার গতি নেই? এবার আর কিছু না হোক, মুক্তির কল্পনা করে অযথা ব্যাকুল হব না। হয়তো এবার মনও বসবে। হয়তো এবার খুব সুখেই থাকব।
বিদায় নেওয়া ঠিক হইয়া গেল বলিয়া বোধ হয় বিন্দু এতদিন পরে গ্রামের দিকে চাহিয়া দেখিল,–আত্মীয় পরিজনের সঙ্গে মেলামেশা করিল। সেদিনকার কাণ্ডের পর সকলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করিতে আজ বিন্দুর সংকোচ হওয়া উচিত ছিল। এ বাড়ির উঠানে নিজের বমির মধ্যে সে যে একদিন গড়াগড়ি দিয়াছিল, সকলের সঙ্গে হঠাৎ তার অবাধ অকুণ্ঠ ব্যবহার দেখিয়া মনে হইল না সেকথা বিন্দুর স্মরণ আছে। রান্নাঘরে কুন্দর ছেলেকে কোলে করিয়া বসিয়া অনেকক্ষণ সে সকলের সঙ্গে গল্প করিল, হাসিল পর্যন্ত। সে যেন স্বামীর গৃহে সহজ ও সাধারণ বধূজীবন যাপন করিয়া বহুদিন পরে বাপের বাড়ি আসিয়াছে,–জীবনে তাহার গ্লানি নাই, অস্বাভাবিকতা নাই,—মনভরা তাহার নির্মল আনন্দ।
খবর পাইয়া পাড়াসুদ্ধ মেয়েরা বিন্দুকে দেখিতে আসিল। অনেকে তাহারা বিন্দুকে জন্মাইতে দেখিয়াছে। বিন্দু আজ তাদের কাছে আকাশের পরীর চেয়েও রহস্যময়ী। অনেক দিন আগে একবার আসিয়া গ্রামকে সে চমকাইয়া দিয়াছিল, এবারও দিয়াছে। আবার সে ফিরিয়া যাইতেছে তাহার অজ্ঞাত রহস্যময় প্রবাসে, তাদের গায়ের মেয়ে বিন্দু। কুসুম এবং পরাণও আসিল। কুসুম চুপিচুপি বিন্দুকে বলিল, বড্ড যে হাসিখুশি দিদি?
বিন্দু বলিল, বরের কাছে যাব যে ভাই!-শীর্ণ মুখে সে অকথ্য হাসি হাসিল।
আবার কবে আসবে?
আর তো আসব না বউ।
পরাণ শশীকে বলিল, মতিদের খোঁজ করবেন ছোটোবাবু?
শশী বলিল, করব বইকী। বৈশাখ মাস পড়ল না? বৈশাখ মাসে কুমুদ সরস্বতী অপেরায় যোগ দেবে বলেছিল পরাণ। দলটার ঠিকানা অবশ্য আমি জানি না, তবে খোঁজ পেতে কষ্ট হবে মনে হয় না।
খবর যদি পান ছোটোবাবু, মতিকে নিয়ে আসবেন। দু-মাস হল গেছে, ছেলেমানুষ তো, কাঁদাকাটা করছে হয়তো।
দু-মাস গিয়াছে? তাই তো বটে। পরাণের মুখের দিকে শশী চাহিতে পারে না! দুমাস হইল মতি গ্রামছাড়া, এর মধ্যে একটা খবরও আসে নাই টাকা চাহিয়াও কুমুদ যদি একখানা পত্র লিখিত! যদি দেখা হয় কুমুদের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করিতে হবে। বুঝাইয়া দিতে হইবে সে কতবড় দায়িত্বজ্ঞানহীন রাস্কেল।
আচ্ছা, মতি তো একখানা চিঠি লিখিতে পারিত তাহার আকাবাঁকা অক্ষরে? কেন লিখিল না? কুমুদের সঙ্গে খেলা করিয়া সময় পায় না? এ ক্ষমতা কুমুদের আছে,– মানুষকে সে আত্মভোলা করিয়া দিতে পারে। তা ছাড়া হয়তো কুমুদ যেমন বিবরণ যেমন লেখে, মিলনের তেমনি অতল উচ্ছল আনন্দে মতি বিশ্বসংসার ভুলিয়া গিয়াছে? শশী একটু হাসে। মতিকে উপন্যাসের নায়িকার মতো ভাবিতে আরম্ভ করিয়াছে, সেও তো কম কল্পনাপ্রবণ নয়!