সেদিন রাত্রে গোপাল থতোমতো খাইয়া গিয়াছিল, সারারাত্রি নিষ্ক্রিয় অবস্থায় গুমরাইয়া গুমরাইয়া পরদিন সকালবেলা তাহার ক্রোধের আগুন দাউদাউ করিয়া জ্বলিয়া উঠিল। বিন্দুকে আনিবার অপরাধে শশীকে সে গালাগালি করিল। অকথ্য, চিৎকার করিয়া বিন্দুকে সে বারবার বলিল দূর হইয়া যাইতে। এমন হতভাগ্য যে মেয়ে, গোপালের বাড়িতে তার একদম ঠাই হইবে না। শশী নির্বাক হইয়া রহিল, বিন্দু ঘরে খিল দিয়াছিল, সেও কোনো সাড়াশব্দ দিল না। সমস্ত সকালটা বাড়ি তোলপাড় করিয়া, একজন মুনিষকে খড়ম দিয়া পিটাইয়া, জামা চাদর লইয়া ছাতা বগলে গোপাল বাহির হইয়া গেল। বলিয়া গেল, কলিকাতা যাইতেছে, কারণ গ্রামে তাহার মুখ দেখাইবার উপায় নাই। ফিরিয়া আসিয়া বিন্দুকে যদি গৃহে দেখিতে পায় বাড়িঘরে গোপাল আগুন ধরাইয়া দিবে।
মেজাজটা শশীর বিগড়াইয়া গিয়াছিল বিন্দুর উপরে কিন্তু তাহার রাগ হইল না। দিন-তিনেক বিন্দুর ঘরের বাহিরে আসিল না-দিবারাত্রি খিল দিয়া ঘরের মধ্যে নিজেকে নির্বাসিত করিয়া রাখিল। শুধু শশীর ডাকাডাকিতে বাহিরে আসিয়া পুকুরে একটা ডুব দিয়া আসে, ঘাড় গুঁজিয়া দুটি ভাত মুখে দেয়, তারপর আবার ঘরে গিয়া খিল বন্ধ করে। কেহ কথা বলিলে জবাবও দেয় না, মুখও তোলে না। তিনদিন পরে কী মনে করিয়া সে ঘরের বাহিরে আসিল, কুন্দর সঙ্গে সহজভাবে দুটি-একটি কথাও বলিল। কিন্তু মিশিতে পারিল না কারো সঙ্গে। এখানে আসিয়া অবধি যেরকম নিজীব নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করিতেছিল তেমনিভাবে দিন কাটিতে লাগিল।
একটা অনাবশ্যক ব্যস্ততার সঙ্গে শশী ঘুরিয়া বেড়ায়, কর্তব্য কাজগুলি সম্পন্ন করে। এতদিন সে রোগীর পরিবারের আত্মীয়-বন্ধুর মতো রোগী দেখিয়াছে, ওষুধের সঙ্গে দিয়াছে আশ্বাস। এখন সে গম্ভীরমুখে রোগীর নাড়ি টেপে, সামান্য কারণে রাগিয়া আগুন হইয়া ওঠে। কোনো কথা একবারের বেশি দুবার বলিতে হইলে বিরক্তির তাহার সীমা থাকে না।
সময়টা চৈত্র মাস। কড়া রোদে মাঠ ভাঙিয়া শশীর পালকি গ্রাম হইতে গ্রামান্তরে যায়, হুহু করিয়া গরম বাতাস বহিতে থাকে। পালকির মধ্যে নিক্রিয় উত্তপ্ত অবসর শশী ভাবিয়া ভাবিয়া ক্ষয় করিয়া ফেলে। বিন্দুর কথা ভাবে, কুসুম ও মতির কথা ভাবে। কুসুম ও মতির সম্বন্ধে নূতন করিয়া কিছু ভাবিবার নাই। বিন্দুর কথা ভাবিয়া সে কুল-কিনারা দেখিতে পায় না। বিন্দুকে সে-ই নন্দর কবল হইতে ছিনাইয়া আনিয়াছে,-ওর সম্বন্ধেসমস্ত দায়িত্ব তাহার। বিন্দু যে বীভৎস কীর্তি করিয়া লোক হাসাইয়াছে, গ্রাম হইতে গ্রামান্তরে অকথ্য দুর্নাম রটনা হইতেছে, এ জন্য শশী নিজেকে অরপাধী মনে করে। তারই দোষ। যে বিষয়ে সে দায়িত্ব গ্রহণ করে তাই ভেস্তাইয়া যায়। একটা অদৃশ্য দুর্বার শক্তি যেন অহরহ তার বিরুদ্ধে কাজ করিতেছে। রূপসী সেনদিদির স্নেহপাত্র ছিল, কুরূপা সেনদিদিকে এড়াইয়া চলিবার ইচ্ছার জন্য তাই নিজেকে আজ অশ্রদ্ধা করিতে হয়। পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করিয়াছিল। তারপর যেদিন আপন হইতেই ওদের অভিভাবকের আসনটি সে পাইয়াছে, সেদিন চিনিতে পারিয়াছে কুসুমের মন, নষ্ট করিয়াছে মতির ভবিষ্যৎ। এবার বিন্দুর এই অবস্থা দাঁড়াইল। বিন্দুকে আনিবার সময় কত কল্পনাই সে করিয়াছিল!—ধীরে ধীরে বিন্দুর মনকে সুস্থ করিয়া তুলিবে, গ্রামের শান্ত আবেষ্টনীতে মনে ওর শান্তি আসিবে, তার স্নেহ যত্ন সাহচর্যে স্বামীহীনা নারীর যত রস ও আনন্দ জীবনে থাকা সম্ভব ক্রমে ক্রমে সব আসিবে বিন্দুর জীবনে : বই পড়িতে এবং ভাবিতে শিখাইয়া একটি অপূর্ব অন্তর্লোক ওর জন্য সে সৃষ্টি করিয়া দিবে। তা যে কতদূর অসম্ভব আজ আর বুঝতে শশীর বাকি নাই।
ভাবিতে শশীর কষ্ট হয়, তবু ইহা সত্য যে শুধু নেশার জন্য বিন্দু সেদিন মদ খাইয়াছিল, আর কোনো কারণে নয়। একদিন হয়তো সাড়াশি দিয়া দাঁত ফাঁক করিয়া তাহাকে নন্দর ও-জিনিসটা গিলাইতে হইয়াছিল, আজ মদ ছাড়া বিন্দুর চলে না। তা ছাড়া, শুধু মদের নেশা নয়, সাত বছর ধরিয়া নন্দ তাহাকে যে উত্তেজনায় অস্বাভাবিক জীবন দিয়াছিল, সেই জীবনও বিন্দুর অপরিহার্য হইয়া উঠিয়াছে। তাহার বিপুল বিকারগ্রস্ত বিরহ তো শুধু নন্দর জন্য নয়—লজ্জাকর বিলাসিতার জন্য, সংগীত ও উন্মত্ততার জন্য। গ্রামের বৈচিত্র্যহীন স্তিমিত নিস্তেজ জীবন বিন্দুর সহিতেছে না।
কী উপায় হইবে বিন্দুর? নন্দর কাছে ফিরিয়া যাইবে? তাহাতেও লাভ নাই। যে বিকৃত অভ্যস্ত জীবনের জন্য বিন্দু মরিয়া যাইতেছে, সে জীবনে ফিরিয়া গেলেও তার সমস্যার মীমাংসা হইবে না। গায়ের জোরে এই অস্বাভাবিক জীবনে বিন্দুর অভ্যাস জন্মানো হইয়াছে, তাই, গৃহস্থকন্যার একটি সংস্কারও তার মরিয়া যায় নাই। ওই অশান্ত উদাম লজ্জাকর অবস্থায় দিন কাটাইতে না পারিলে তাহার চলিবে না, কিন্তু সেজন্য লজ্জায় দুঃখে অনুতাপে যন্ত্রণাও সে পাইবে অসহ্য। আকণ্ঠ মদের পিপাসার সঙ্গে বিন্দুর মনে মদের প্রতি এমন মারাত্মক ঘৃণা আছে যে নেশার শেষে আত্ম গ্লানিতে সে আধমরা হইয়া যায়।
কী হইবে বিন্দুর?
বিন্দুর লজ্জা ভাঙিয়াছে। কোণঠাসা ভীরু জন্তুর একটা হীন সাহস জাগিয়াছে তাহার। রাতদুপুরে উঠিয়া আসিয়া সে দরজা ঠেলিয়া শশীর ঘুম ভাঙায়, ঘুমের ওষুধ চায়, মাথা ধরার প্রতিকার প্রার্থনা করে।
শশী বলে, চুপচাপ শুয়ে থাকবি যা, ঘুম আসবে। মাথাধরাও কমে যাবে।