শশী বলে, কাঁদিস না। আমার ওষুধ খেলেই মন ভালো হয়ে যাবে। বিন্দুর রোগ-নির্ণয় করা শশীর অসাধ্য মনে হয়। মনের মধ্যে দিনরাত হুহু করিয়া জ্বলে। কার জন্য জ্বলে, কেন? জীবনটা ব্যর্থ হইয়া গেল বলিয়া মানুষ কি শোকে এমন নিজীব মৃতপ্রায় হইয়া যায়? নন্দর প্রতি তীব্র বিদ্বেষই তো বিন্দুকে দুদিন সুস্থ ও সবল করিয়া তোলার পক্ষে যথেষ্ট। বিদ্বেষ যদি নাও হয়, আকাশছোয়া অভিমান বিন্দুকে নবজীবন দিতেছে না কেন? নন্দ ক্ষমা করিবে এই আশায় অতগুলি বছর বিন্দু যে অবস্থায় কাটাইয়া আসিয়াছে তাহাতে যদি আজ নন্দর জন্যই বিন্দুর মন হাহাকার করে, শশী তাহাতে বিস্মিত হইবে না। সংসারে এরকম অদ্ভুত মেয়ে দু-চারটা থাকে। কিন্তু নন্দর জন্য মন কেমন করিলে বিন্দুর তো উচিত অস্থির চঞ্চল হইয়া থাকা, কাজ ও অকাজের ভানে ছটফট করা। এমন সে অলস ও অবসন্ন হইয়া আসিবে কেন,—তৈলহীন প্রদীপের মতো কেন সে নিভিয়া যাইতে থাকিবে?
একদিন বিন্দু বলিল, দাদা আলমারির চাবি দাও। বই নেব।
শশী বলিল, বাঙলা বই বেশি তো নেই আলমারিতে। বই যদি পড়িস তো আনিয়ে দেব শহর থেকে।
আলমারিতে যা আছে তাই তো এখন পড়ি, শহর থেকে যখন আনিয়ে দেবে দিও!
শশী চাবির গোছাটা তাহার হাতে দিল। আলমারি খুলিয়া একখানা বই বাহির করিয়া আবার বিন্দু আলমারি বন্ধ করিল বটে, চাবি ফেরত দিল না। বলিল, চাবি আমার কাছে থাক। তুমি তো বেড়াও রোগী দেখে, আর একটা বই বার করতে হলে সারাদিন তোমার দেখাই পাব না।
শশী বলিল, গোছাসুদ্ধ রেখে কী করবি? বই-এর আলমারির চাবিটা খুলে নে।
বিন্দু বলিল, থাক না গোছাসুদ্ধই—ইচ্ছে হলে তোমার বাক্স-প্যাটরা ঘেঁটেও তো সময় কাটাতে পারব দু-দণ্ড? বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাব না আমি, চাবির দরকার হলে আমায় ডেকো।
এমন সহজভাবে সে কথাগুলি বলিল যে শশীর মনে কোনো সন্দেহই আসিল না। হয়তো অন্যমনস্ক ছিল বলিয়াও শশীর মনে পড়িল না ওষুধের আলমারিতে চার-পাঁচ শিশির গায়ে লাল অক্ষরে বিষ লেখা আছে। বিন্দুকে সে যে কতদিন উৎসুক লোভাতুর দৃষ্টিতে ওষুধের আলমারির দিকে চাহিয়া থাকিতে দেখিয়াছে খেয়াল করিলে তাও হয়তো শশীর মনে পড়িত।
সেদিন বিকেলে মাইল পাচেক দূরে একটা গ্রামে শশী রোগী দেখিতে গিয়াছিল। গ্রামে ফিরিতে রাত প্রায় নটা হইয়া গেল। বাড়ির সামনে পৌঁছিয়াই অন্দরে একটা গোলমাল শশীর কানে আসিল। বাহিরের ঘরগুলি অন্ধকার, জনপ্রাণী নাই। কেবল সিন্ধু এক অন্ধকারে দাঁড়াইয়া মৃদুস্বরে কাঁদিতেছে। শশী ভীত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কী হয়েছে রে সিন্ধু?
সিন্ধু কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, মেজদি মরে যাচ্ছে দাদা।
ভিতরে যাইতে শশীর পা উঠিতেছিল না। বিন্দু মরিয়া যাইতেছে? কেন মরিয়া যাইতেছে? সিন্ধু গুছাইয়া তাকে কিছু বলিতে পারিল না। তবু ব্যাপারটা অনুমান করিতে শশীর দেরি হইল না। সন্ধ্যার সময় কী যেন বিন্দু খাইয়া ছিল, তাই এখন মরিয়া যাইতেছে। শশীর বুকের ভিতরটা হিম হইয়া গেল। ডাক্তার মানুষ সে, এরকম খবর পাইয়া জড়ভরতের মতো এখানে দাঁড়াইয়া থাকা উচিত নয়, এসব শশী বুঝিতে পারিতেছিল, তবু খানিকক্ষণ সে নড়িতে পারিল না। বিন্দু বিষ খাইয়াছে। মরিতে চায় বিন্দু? পলকের জন্য শশীর যেন মনে হয় বিন্দুর এ ইচ্ছা সফল হইতে দিলে মন্দ হয় না। আলমারিতে কী বিষ ছিল শশী জানে, সন্ধ্যার সময় বিন্দু যদি তাহ খাইয়া থাকে ওকে সে বঁাচাইতে পারবে। কিন্তু কী হইবে বাঁচাইয়া? বিন্দু ছেলেমানুষ নয়, জীবন সম্বন্ধে দু”প্রাপ্য অভিজ্ঞতা তাহার, ভাবিয়া চিন্তিয়া দুঃখের হাত এড়াইবার চরম পন্থাই সে যদি অবলম্বন করা ঠিক করিয়া থাকে, বাধা দেওয়া কি উচিত হইবে?
কপালের ঘাম মুছিয়া, বাহিরের বিস্তৃত অঙ্গন পার হইয়া কুন্দর ঘরের পাশ দিয়া শশী অন্দরের অঙ্গনে আসিয়া দাঁড়াইল। বিন্দু উঠানেই পড়িয়া আছে, নিজের বমির মধ্যে, বিস্রস্ত বসনে। বাড়ির সকলে এবং পাড়ার অনেকে চারিদিকে ভিড় করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। শশীকে দেখিয়া সকলে কলরব করিয়া উঠিল। মুখরা কুন্দ সকলের কণ্ঠ ছাপাইয়া বলিল, ও শশীদাদা, কী কাণ্ড করছে বিন্দুদিদি দেখুন।
মদের তীব্র গন্ধ শশীর নাকে লাগিতেছিল, সে বিহবলের মতো জিজ্ঞাসা করিল, কী হয়েছে রে কুন্দ?
কুন্দ বলিল, বিকেল থেকে যা কাণ্ড বিন্দুদিদি আরম্ভ করেছিল, যদি দেখতে শশীদাদা এই হাসে, এই কাঁদে, এক্ষুনি আবার গান ধরে দেয়-ভয়ে তো আমাদের হাত-পা সেদিয়ে গেল পেটের মধ্যে। কী করেছে-জানেন? আপনার ওষুধের আলমারি খুলে—
আর কিছু শুনিবার দরকার ছিল না। শশী বিন্দুর কাছে গিয়া বসিল। নাড়ি দেখিয়া কুন্দকে বলিল, এখানে এমন করে পড়ে আছে, ধুইয়ে মুছিয়ে ঘরে নিয়ে শুইয়ে দিতে পারলি না তোরা কেউ?
কুন্দও কৈফিয়ত দিয়া বলিল, ধরতে গেলে কামড়াতে আসে যে!
শশী বলিল, এখন তো ইশও নেই কুন্দ? এক কলসি জল নিয়ে আয়।
বিন্দুকে শশী স্নান করাইয়া দিল। তারপর কয়েকজনের সাহায্যে ধরাধরি করিয়া ঘরে শোয়াইয়া দিল।
এও একটা কলঙ্ক বইকী! ক দিন গ্রামে খুব একচোট হৈচৈ হইয়া গেল। ভদ্রপরিবারের অন্তঃপুরে এ কী বিসদৃশ কাণ্ড পুরুষমানুষ মদ খায়, মাতলামি করে, বমি করিয়া ভাসাইয়া দেয়, লোকে নিন্দা করে, কিন্তু আশ্চর্য হয় না। বাড়ির মেয়ে এমন বীভৎস ব্যাপারের নায়িকা হইতে পারে তা যে কল্পনা করাও যায় না। যারা উপস্থিত থাকিয়া বিন্দুর মাতলামি দেখিতে পায় নাই তারা আপশোশ করিয়া মরে,–সকলকে বিস্তারিত বর্ণনা শুনাইতে শুনাইতে প্রত্যক্ষদর্শীদের হয় সুখকর প্রাণান্ত।