মাগুরটাগুর পেলি নবীন? পেলে আমাকে একটা দিস। ছেলেটা কাল পথ্যি করবে।
নবীন মিথ্যা জবাব দেয়। বলে, জলে দেঁড়িয়ে কি মিছা কথা কইছি। এত জলে মাছ পড়ে না। ইদিকে তিন হাত ফাঁক রইছে দেখছ নি?
হারুর মরণের খবরটা সে শান্তভাবে গ্রহণ করে।
বলে, লোক বড় ভালো ছিল গো। জগতে শত্তুর নেই।
তারপর বলে, ই বছর, জান ঘোষ মশায়, অদৃষ্ট সবার মন্দ। তিন বর্ষা নাবল না, এর মধ্যে জল কামড়াতে নেগেছে।
দিন নাই রাত্রি নাই, জলে স্থলে নবীনের কঠোর জীবনসংগ্রাম। দেহের সঙ্গে মনও তাহার হাজিয়া গিয়াছে। হারুর অপমৃত্যুতে বিচলিত হওয়ার সময় তাহার নাই।
অথচ এদিকে মমতাও জানে। দশবছরের ছেলেটা বিকাল হইতে পুলের উপর ঠায় দাঁড়াইয়া আছে। জলে নামিয়া বাপের মতো সেও মাছ ধরিতে চায়। কিন্তু নবীন কোনোমতে অনুমতি দিবে না।
রেতে লয় বাপ, জ্বর হবে। কাল বিহানে আসিস।
বিহানে জল রইবে নি বাবা।
হু, রইবে নি আবার! তোর ডুবজল হবে, জনিস্।
পুল পার হইয়া কিছুদূর অবধি রাস্তার দুপাশে শুধু চষা ক্ষেত। তারপর গ্রাম আরম্ভ হইয়াছে। এদিকে বসতি কম। রাস্তার দক্ষিণে ঝোপঝাপের বেষ্টনীর মধ্য পৃথক কয়েকটা ভাঙাচোরা ঘর বৃষ্টিতে ঘর-বাইরে ভিজিয়াছে। ওখানে সাত ঘর বাগদী বাস করে গ্রামের ছেলেমেয়েদের মধ্যে ওরাই সবচেয়ে গরিব, সবচেয়ে ছোটলোক, সবচেয়ে চোর। দিনে ওরা যে-গৃহস্থের চাল মেরামত করে, রাত্রে সুযোগ পাইলে তাহারই ভিটায় সিঁধ দেয়। কেহ-না-কেহ ওদের মধ্যে ছ মাস এক বছর জেলেই পড়িয়া আছে।
ছাড়া পাইবার পর গ্রামে ফিরিয়া বলে, শ্বশুর-ঘর থে ফিরলুম দাদা। বেশ ছিলাম গো!
একটুকু পার হয়ে গেলে বসতি ঘন হইয়া আসে। বাড়িঘরের উন্নত অবস্থা চোখে পড়ে। পথের দুইদিকেই দুটি-একটি শাখা-পথ পাড়ার দিকে বাহির হইয়া যাইতে আরম্ভ করিয়াছে দেখা যায়। মাঝে মাঝে কলাবাগান সুপারিবাগান ও ছোট ছোট বাঁশঝাড় ডাইনে বায়ে আবির্ভূত হয়। আমবাগানকে অন্ধকারে মনে হয় অরণ্য। কোনো কোনো বাড়ির সামনে কামিনী গন্ধরাজ ও জবাফুলের বাগান করিবার ক্ষীণ চেষ্টা চোখে পড়ে। ক্রমে দু একটি পাকা দালানের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। বাড়িগুলি আগাগোড়া দালান নয়, এক ভিটায় দুখানা ঘর হয়তো ইটের, বাকিগুলি শণে ছাওয়া চাচের বেড়ায় গ্রামেরই চিরন্তন নিজস্ব নীড়।
নির্জন স্তব্ধ পথে শববাহী তাহারাই জীবনের সাড়া দিয়া চলিয়াছে। শশীর বিষন্নতা ঘুচিবার নয়। আলো হাতে সকলের আগে আগে সে যাইতেছিল। নিতাই, সুদেব ওরা কথা কহিতেছে সকলেই, কথা নাই কেবল শশীর মুখে। পথের ধারে কোনো বাড়িতে আলো জ্বলিতেছে দেখিলে তাহার ইচ্ছা হয় হাঁক দিয়া বাড়ির লোকের সাড়া নেয়। এক মিনিট দাঁড়াইয়া অকারণে বাড়ির সকলের কুশল জিজ্ঞাসা করে। তাহার সাড়া পাইয়া কান্নার রোল তুলিবে না এমন একটি পরিবারের খবর না লইয়া হারুর বাড়ির দিকে চলিতে সে যেন জোর পাইতেছিল না।
খানিক আগাইয়া বাজার।
এখানে গ্রাম জমাট বাঁধিয়াছে। দোকানটাটের সংখ্যা কম নয়। কিন্তু বাদলের রাত্রি গভীর হওয়ার আগে সবগুলি দোকানই এখন বন্ধ হইয়া গিয়াছে। রাস্তার বাঁ দিকে একটা ফাঁকা জায়গায় কতকগুলি টিনের চালা। একদিন অস্তুর
ওখানে বাজার বসে।
কোথা হইতে এক সন্ন্যাসী আসিয়া একটা চালার নিচে আশ্রয় লইয়াছে। সম্মুখে তাহার ধুনির আগুন। আগুনে সন্ন্যাসী মোটা রুটি সেকিতেছিল। ওদিকের চালাটায় লোম-ওঠা শীর্ণ কুকুরটা থাবায় মুখ রাখিয়া তাহাই দেখিতেছে। শশী তাড়াতাড়ি আগাইয়া গেল। তার পা বারবার জলকাদা-ভরা গর্তে গিয়া পড়িতেছিল! মনের গতির আজ সে ঠিক-ঠিকানা পাইতেছিল না।
শ্ৰীনাথ দাসের মুদিখানার পাশ দিয়া কায়েত পাড়ার পথটা বাহির হইয়া গিয়াছে। হারুর বাড়ি এই পথের শেষ সীমায়। তারপর আর বাড়িঘর নাই। ক্রোশব্যাপী মাঠ নিঃসাড়ে পড়িয়া আছে!
পথের মোড়ে বকুলগাছটির গোড়া পাকা বাঁধানো। বিকালের দিকে এখানে প্রত্যহ সরকারি আড্ডা বসে। আলোটা ওখানে নামাইয়া রাখিয়া শশী একটা বিড়ি ধরাইল। চাহিয়া দেখিল গাছের নিচে শুকনো ভাল ও কাঁচা-পাকা পাতার সঙ্গে পাতার উপর ন্যাকড়া-জড়ানো একটা পুতুল পড়িয়া আছে। পুতুলটা শশী চিনিতে পারিল। বৈশাখ মাসে বাজিতপুরের মেলায় শ্রীনাথের দোকানে বসিয়া একঘণ্টা বিশ্রাম করার মূল্যস্বরূপ তাহার মেয়েকে পুতুলটা কিনিয়া দিয়াছিল। বিকালে বৃষ্টি থামিলে এখানে খেলিতে আসিয়া শ্ৰীনাথের মেয়ে পুতুলটা ফেলিয়া গিয়াছে।
রাত্রে পুতুলের শোকে মেয়েটা কাঁদিবে। সকালে বকুলতলা খুঁজিতে আসিয়া দেখিবে পুতুল নাই। পুতুল কে লইয়াছে মেয়েটা তাহা জানিতে পারবে না।
শশী কেবল অনুমান করিতে পারিবে যামিনী কবিরাজের বৌ ভোর ভোর বকুলতলা ঝাঁট দিয়া আসিয়া দেখিতে পাইয়া তুলিয়া লইয়া গিয়াছে।
যামিনী কবিরাজের বৌ চোরও নয় পাগলও নয়; মাটির পুতুলে সে লোভ করে না। কিন্তু প্ৰণাম করিয়া (যে গাছের তলা বাঁধানো, সেটি দেবধর্মী) মুখ তুলিতেই সামনে অত বড় একটা পুতুল পড়িয়া থাকিতে দেখিলে একথা মনে হওয়ার মধ্যে বিস্ময়ের কী আছে যে এ কাজ দেবতার, এই তাঁহার ইঙ্গিত।
পুতুলটিকে আরও খানিকটা গাছের গোড়ার দিকে ঠেলিয়া দিয়া আলোটা তুলিয়া লইয়া শশী আগাইয়া গেল। বলিল, সাবধানে পা ফেলে চলো নিতাই, আস্তে পা ফেলে চলো। ফেলে দিয়ে হারুকে কাদা মাখিও না যেন। কী রাস্তা!