কুসুম নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, আপনার কাছে দাঁড়ালে আমার শরীর এমন করে কেন ছোটোবাবু?
শরীর! শরীর! তোমার মন নাই কুসুম?
০৭. মতিকে লইয়া কুমুদ চলিয়া গিয়াছ
বিবাহের পর মতিকে লইয়া কুমুদ চলিয়া গিয়াছ।
কোথায়! হনিমুনে! গাওদিয়ার গেঁয়ো মেয়ে মতি, তাকে লইয়া কুমুদ চলিল হনিমুনে। কিছু টাকা দে শশী।
পরাণের কাছে এ ব্যাপারটা বড় দুর্বোধ্য ঠেকিয়াছে। কনে-বউকে সঙ্গে লইয়া অনির্দিষ্ট ভ্রমণে বাহির হওয়া? এ কোনদেশী রীতি মতিকে লইয়া গিয়া উঠিতে পারে এমন আত্মীয়স্বজন কুমুদের কেহ নাই পরাণ তাহা জানিত। সে আশা করিয়াছিল কুমুদ এখন সন্ত্ৰীক কিছুদিন শশীর বাড়িতেই বাস করিবে। তারপর মতির রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করিয়া সংসার পাতিয়া বসিবে শহরে অথবা গ্রামে। রাতারাতি বোনটাকে লইয়া কোথায় উধাও হইয়া গেল কুমুদ?
এ বিবাহে পরাণের আনন্দ হয় নাই, শুধু শশীর মুখ চাহিয়া সে সম্মতি দিয়াছিল। হোক সে গরিব গ্রাম্য গৃহস্থ, মতির সে বড়ভাই, কুমুদের গুরুজন,–কিন্তু আগাগোড়া কী উদ্ধত অপমানজনক ব্যবহার কুমুদ তার সঙ্গে করিয়া গিয়াছে! শশীও এটা লক্ষ করিয়াছিল। রাগ তাহার কম হয় নাই। মতিকে যদি কুমুদ বিবাহ করিতে পারে, মতির দাদাকে সম্মান করিতে পারবে না? কিন্তু মুখে সে কিছুই বলে নাই কুমুদকে। শুধু তার সামনে পরাণের সঙ্গে করিয়াছিল প্রীতি ও শ্রদ্ধাপূর্ণ ব্যবহার,–কুমুদ যাতে দেখিয়া শিখিতে পারে। শশীর এ চেষ্টার বিশেষ কিছু ফল হয় নাই। মতির আত্মীয়-পরিজনের প্রতি অসীম অবজ্ঞা দেখাইয়া মতিকে কুমুদ গ্রহণ করিয়াছিল।
মাঠে পরাণের খেজুররস জ্বাল হইতেছে। দুপুরে ছাড়া শশীর সময় হয় না বলিয়া পরাণ দেড় মাইল পথ হাটিয়া আসিয়া কাজের ক্ষতি করিয়া শশীর কাছে বসিয়া থাকে। চওড়া সবল কাঁধদুটি যেন তাহার শ্রাত্তিতে ঢালু হইয়া আসে। বলে পত্র দেয় না কেন ছোটোবাবু?
শশী অপরাধীর মতো বলে, কী জানো পরাণ, চিঠিপত্র লেখা কুমুদের অভ্যাস নেই। কলেজে পড়বার সময় ওর বাবা হোস্টেলের সুপারিন্টেন্ডেন্টকে লিখে ওর খবর নিতেন।
তাই বলে একবারটি জানাবে না কোথায় গেল, কোথায় উঠল, কী বিত্তান্ত? মা ইদিকে কাঁদাকাটা জুড়েছে।
কুমুদকে মনে মনে অভিশাপ দিয়া শশী বলে, আসবে পরাণ, পত্র আসবে। খবর না দিয়া পারে? আজ হোক কাল হোক খবর একটা দেবেই।
পরাণ কেমন একপ্রকার স্তিমিত বিষন্ন দৃষ্টিতে শশীর দিকে চাহিয়া থাকে। নীরবে সে যেন কিসের নালিশ জানায়, মূক প্রাণীর মতো। শশীর অস্বস্তির সীমা থাকে না। হারু ঘোষের পরিবারে ভালোমদের দায়িত্ব শশীকে কেহ দেয় নাই, তবু চিরদিন ওদের মঙ্গল করিতে চাহিয়াছে বলিয়া আপনা হইতে দায়িত্ব যেন তাহার জন্মিয়াছে। কিন্তু কী মঙ্গল সে করিতে পারিয়াছে ওদের? তার দোষ নাই, তবু তারই জন্য কুসুম যেন কেমন হইয়া গেল। একটা খাপছাড়া বিপজ্জনক বিবাহ হইল মতির হয়তো পরাণ আজ এসব হিসাব করিয়া দেখিতেছে, হয়তো তাদের অসমান বন্ধুত্বের ফলাফলে বিচলিত হইয়া উঠিয়াছে পরাণ, ভীত হইয়া ভাবিতেছে ভালো করিতে চাহিয়া আরও না জানি কত মন্দ শশী তাদের করিবে!
শশী জানে মুখ ফুটিয়া পরাণ কোনো বিষয়ে তাহাকে দোষী করিরে না।– শুধু বিষন্ন চিন্তিত মুখে দুর্বোধ্য-রহস্য-দ্রষ্টা শিশুর মতো তার দিকে চাহিয়া থাকিবে। দীর্ঘদেহ নির্ভরশীল সরল লোকটির জন্য শশীর মন মমতায় ভরিয়া যায়। ভাবে যেমন করিয়াই হোক মতিকে সুখী করিতে কুমুদকে সে বাধ্য করবে। মতি বদলাক, মতিকে কুমুদ যেমন খুশি গড়িয়া তুলুক-তার মুখে চোখে উপচানো সুখের সঙ্গে পরাণের ঘটা চাই।
শুধু মতির জন্য নয়, নানা দিকে শশীর চিত্তা বাড়িয়াছে। তার মধ্যে বিন্দুর সম্বন্ধে চিন্তাটা গুরুতর। দিন দিন বিন্দু কেমন হইয়া যাইতেছে। ভুলিয়া থাকিতে পারবে বলিয়া প্রকান্ড সংসারটা চালানোর ভার শশী মাসি-পিসির কবল হইতে ছিনাইয়া বিন্দুর হাতে তুলিয়া দিয়াছিল। বিন্দু জীবনে কখনও সংসার পরিচালনা করে নাই। সে কেন এ ভার বহন করিতে পরিবে? তা ছাড়া বিন্দুর ভালোও লাগে নাই। সব ভার সে আবার একে একে মাসি-পিসিকে ফিরাইয়া দিয়াছে। কাজ করিতে বিন্দুর আলস্য বোধ হয়। মানুষের সঙ্গ তাহার ভালো লাগে না। কথাবার্তা কারো সঙ্গেই সে বেশি বলে না, নিজের মনে চুপচাপ ঘরের কোণে বসিয়া থাকে। বসিয়া বসিয়া ঝিমায়। কত কাল অনবরত রাত জাগিয়া সে যেন নিদ্রাতুরা হইয়া আছে এমনিভাবে সর্বদা হাই তোলে অথচ ঘুমায় সে খুব কম। কিছু সে খাইতে চায় না, দিন দিন শুকাইয়া যাইতেছে। আধমরা মানুষের মতো শিথিল নিস্তেজ ভঙ্গিতে সে দীর্ঘ দিবারাত্রি যাপন করে।
শশী ডাক্তার মানুষ, বিন্দুকে নিজের ঘরে ডাকিয়া লইয়া সে জিভ দ্যাখে, হার্ট পরীক্ষা করে, শরীরের অবস্থা সম্বন্ধে জেরা করে। তারপর সন্দিগ্ধভাবে মাথা নাড়িয়া বলে, কিছু বুঝতে পারলাম না বাপু। গায়ের ডাক্তার, পেটে তো বিদ্যে নেই তেমন একটা ওষুধ দিচ্ছি, কদিন খা, তারপর আবার পরীক্ষা করে দেখব।
বিন্দু বলে, উঁহু, ওষুধ আমি খাব না!
শশী বলে, খাবি। মুখ দিয়ে না খাস, গা ফুঁড়ে দেব। বাপের বাড়ি এসে তুই যদি মরে যাস বিন্দু আমি থাকতে, আমার তাতে কী অপমান হবে বল দিকি?
বিন্দু কাঁদিয়া ফেলে। কাঁদিতে কাঁদিতেই বলে, কী করব দাদা, মনে বল পাই না, দিনরাত হুহু করে জ্বলে মনের মধ্যে।