ভাবিয়া শশী কিছু ঠিক করিতে পারে না। একসময় সে খেয়াল করিয়া অবাক হয় যে মতির সঙ্গে কুমুদের ভালোবাসার খেলাটা তাহার বিশেষ খাপছাড়া মনে হইতেছে নাওদের বিবাহের কথাটাই তার কাছে সৃষ্টিছাড়া কাণ্ডের মতো ঠেকিতেছে। মতিকে নষ্ট করিয়া কুমুদ যদি চলিয়া যাইত, শশীর দুঃখের সীমা থাকিত না, তবু যেন মনে হইত অস্বাভাবিক কিছু ঘটে নাই, দুইজনের মধ্যে যে দুস্তর পার্থক্য তাহদের তাহাতে দুদিনের নিন্দনীয় ঘনিষ্ঠতা ছাড়া আর কী সম্পর্ক তাহাদের মধ্যে হওয়া সম্ভব? ওদের বিবাহ অবাস্তব, অর্থহীন।
এ চিন্তায় শশী লজ্জা পায়। মতির জন্য তার মনে বাৎসল্য-মেশানো একপ্রকার আশ্চর্য মমতা আছে, মতিকে কুমুদের বউ হওয়ার অনুপযুক্ত মনে করিতে তাহার কষ্ট হয়। সেদিন বিকালে মতির সঙ্গে শশীর দেখা হইল। মতি একডালা কুমড়াফুল লইয়া তাহাদেরই বাড়ি আসিয়াছিল। শশীকে যে কথাটা জানানো হইয়াছে, কুমুদ হয়তো মতিকে এ সংবাদ দিয়াছিল। শশীকে দেখিয়া মুখখানা তার রাঙা হইয়া উঠিল। তারপর একটু হাসিল মতি,–হঠাৎ লজ্জা পাইলে এ বয়সে ঠোঁটে একটু হাসির ঝিলিক দিয়া যায়। মতির মুখখানা আজ শশীর অসাধারণ সুন্দর মনে হল। সে ভাবিল, হয়তো কুমুদ ভুল করে নাই। হয়তো সত্যই একদিন সে মতিকে রূপে-গুণে অতুলনীয়া করিয়া তুলিবে।
মতি চলিয়া গেলে কুমুদের এই শক্তিতে কিন্তু শশীর আর বিশ্বাস রহিল না। খনিগর্তেও হীরার মতোই বটে মতি, তাকে একদিন অনুপমা ও জ্যোতির্ময়ী করিয়া তোলাও সম্ভব, কিন্তু কুমুদ তাহা পরিবে না। ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখিবার প্রতিভা আছে কুমুদের, স্বপ্নকে সফল করিবার তপস্যা নাই। মতির মুখের পেলব ত্বকে দুদিনে সে দুঃখের রেখা আনিয়া দিবে।
মনটা শশীর খারাপ হইয়া থাকে। কুমুদের প্রতি সে বিতৃষ্ণা বোধ করে সীমাহীন। এ কি বন্ধুর কাজ বন্ধুর বাড়ি আসিয়া তাহার মেহের পাত্রীর সঙ্গে গোপনে ভালোবাসার খেলা করা? উপায় থাকিলে কুমুদকে সে তাড়াইয়া দিত। কিন্তু কুমুদের কথা শুনিয়া আর তো মনে হয় না মতির কোনোদিকে আশা-ভরসা আছে। কুমুদের সম্বন্ধে মতির উৎসুক প্রশ্ন, কুমুদকে দেখিবার আশায় মতির কলিকাতা যাওয়ার আগ্রহ, সব এখন শশীর মনে পড়িতে থাকে। প্রেম? কুমুদের জন্য এতখানি প্রেম জাগিয়াছে মতির বুকে? তা ছাড়া, হয়তো মতির বুকভরা প্রেমই শুধু নয়-কুমুদকে বিশ্বাস নাই, জীবনটা কুমুদের আগাগোড়া অসঙ্গতিতে পরিপূর্ণ।
কী করিবে শশী ভাবিয়া পায় না। এ ব্যাপারেও তার সিদ্ধান্তই চরম। সে যদি বলে হোক, তবেই এ বিবাহ হইবে-পরাণের কাছে কথাও পাড়িতে হইবে তাহাকেই। শশীর ইচ্ছা হয়, যাই ঘটিয়া থাক-কুমুদকে সে এইদণ্ডে দূর করিয়া দেয়। চিরদিনের জন্য বন্ধুত্বের অবসান হোক, কুমুদ চলিয়া যাক তাহার যাযাবর জীবন যাপনে— গায়ের মেয়ে মতি থাকে গাঁয়ে। চিরকাল মতি দুঃখ পাইবে জানিয়াও এ বিবাহ সে ঘটিতে দিবে কেমন করিয়া।
সন্ধ্যার পর কুসুমের সঙ্গে শশী এ বিষয়ে পরমাশ করার সুযোগ পাইল। আকাশে তখন চাঁদউঠিয়াছিল। ঘরের চালা যে জ্যোৎস্নার ছায়া ফেলিয়াছিল সে ছায়ায় দাঁড়াইয়া অনেক কথা বলিবার পর শশী বলিল, একটা উপায় আছে বউ।
কী উপায়? কুসুম জিজ্ঞাসা করিল।
আমি মতিকে বিয়ে করতে পারি।
এই উপায়! কুসুম হাসিয়া ফেলিল।
শশী কিন্তু হাসিল না, বলিল, হাসির কথা নয় বউ। কুমুদের হাতে ওকে সপে দিতে সত্যি আমার ভাবনা হচ্ছে।
কুসুম গম্ভীর হইয়া বলিল, সে আপনি ওকে ছোটবোনটির মতো ভালোবাসেন বলে। মেয়ে, বোন—এদের বিয়ে দেবার সময় মানুষের এরকম ভাবনা হয়।
শশী তবু বলিল, আমি যদি মতিকে বিয়ে করি—
যদি করেন! যদি! তীব্র চাপা গলায় এই কথা বলিয়া কুসুম পরক্ষণেই আবার হাসিয়া ফেলিল, সংসারে অত যদি চলে না ছোটোবাবু। আপনি করবেন মতিকে বিয়ে! জীবনটা আপনার নষ্ট হয়ে যাবে না?
তখন শশী বলিল, কুমুদ অবশ্য একেবারে অমানুষ নয়, রোজগার-পাতিও মন্দ করে না–
কুসুম বলিল, মতির ভাগ্যি ওকে কুমুদবাবুর পছন্দ হয়েছে। পড়ত গিয়ে কোনো চাষার ঘরে,—দুবেলা চেলাকাঠের মার খেয়ে প্রাণটা ছুঁড়ির বেরিয়ে যেত। অনেক পুণ্যতে এমন বর জুটেছে ওর।
হোক হবে, তাই হোক মতি কী বলে বউ?
কী বলবে? দিন গুনছে।
দিন গুনিতেছে মতি? গুনুক!
কুসুমের উপর রাগে শশীর মন জ্বালা করিতে থাকে। সেদিন প্রত্যুষে তালবনে কুসুমের মধ্যে যে সরলা বালিকাকে আবিষ্কার করিয়া সে পুলকিত হইয়াছিল, আজ সে কোথায় গেল? কী পাকা বুদ্ধি কুসুমের কী নিখুঁত কৌশলে মতির বিবাহ সম্বন্ধে সে তার মনের মোড় ঘুরাইয়া দিল। দুদিন ভাবিয়া সে যা স্থির করিতে পারে নাই, আধঘণ্টার মধ্যে দুটো আচল যুক্তি দেখাইয়া কুসুম কত সহজে সব সমস্যার মীমাংসা করিয়া দিল। কুসুমের কাছে দাঁড়াইয়া মতির ভালোমন্দ সম্বন্ধে এমন সে নির্বিকার হইয়া উঠিল কিসে যে অনায়াসে বলিয়া বসিল, হোক তবে, তাই হোক? তাছাড়া, এসব আজ কী বলিতেছে কুসুম?
এমনি চাঁদনি রাতে আপনার সঙ্গে কোথাও চলে যেতে সাধ হয় ছোটোবাবু।
গভীর দুঃখের সঙ্গে শশীর মনে হয়, একথা কুসুমের বানানো। মতিকে পাছে সে আবার নিজে বিবাহ করিয়া কুমুদের হাত হইতে বাঁচাইতে চায়, তাই কুসুম এই মনরাখা বলিয়াছে। বলুক। সে তো কুমুদ নয়, তার জীবনে সবই অভিনয়। তবু, চাঁদের আলোয় চারিদিক আজ কেমন স্বপ্ন দেখিতেছে দ্যাখো। এ যেন বিশ্বাস করিতে ইচ্ছা হয় ন কুসুমের কুটিলতার বিষে এমনি সময় এত কষ্ট পাওয়া তাহার ভাগে ছিল। কিন্তু কেন সে দাঁড়াইয়া আছে, কেন সে চলিয়া যাইতে পারে না? কে জানে, হয়তো জীবনের বিতৃষ্ণা ও আত্মপ্লানি-ভরা মুহূর্তগুলির আকর্ষণ তার কাছেই এত তীব্র? কুমুদ হয়তো ছুটিয়া পলাইত, বলিয়া যাইত, তুমি গোল্লায় যাও কুসুম। অথবা হয়তো নিজের আনন্দ দিয়া, এই জ্যোৎস্নার কবিতাটুকু ছাঁকিয়া লইয়া এমনি স্থূল মুহূর্তগুলিকে অপূর্ব করিয়া তুলিত?