ব্যাগটা হাতে করিতে শশী লজ্জা বোধ করিল।
কত আছে?
কে জানে কত আছে। গুনে দ্যাখ।
তারপর একদিন পুকুর-ডোবা-জঙ্গলভরা গাওদিয়া গ্রামে কুমুদের আত্মনির্বাসনের কারণটা জানা গেল।
শশী বিবর্ণ হইয়া বলিল, তুই কী বলছিস কুমুদ, মতিকে বিয়ে করবি? ওইটুকু মেয়ে।
কুমুদ বলিল, বিশেষ ছোট নয়। তা ছাড়া, ছোটই ভালো। বিয়েই যদি করব, ধাড়ি মেয়ে বিয়ে করব কোন দুঃখে?
শশীর রাগ হইতেছিল। কেমন একটা জ্বালাও সে বোধ করিতেছিল, বলিল, তুই তবে এইজন্য এসেছিলি কুমুদ, বন্ধুর বাড়ি, বিশ্রামের ছল করে?
কুমুদ বিস্মিত হইয়া বলিল, বিচলিত হইয়া পড়লি যে শশী? খুব কী একটা অন্যায় কাজ করতে বসেছি আমি? ছন্নছাড়ার মত ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছিলাম,-বিয়ে করে সংসারী হব, এতে তোর খুশি হওয়াই তো উচিত।
বাংলাদেশে তাই আর মেয়ে পেলি না?
কেন, মতি কী দোষ করেছে?
ওইটুকু একটা মুখ্য গেঁয়ো মেয়ে।
কুমুদ একটু হাসিল, তুই যে কার দিকে টানছিস বুঝে উঠতে পারছি না শশী। মতি মুখ্য গেঁয়ো মেয়ে বটে, আমিও তো যাত্ৰাদলের সঙ!
কুমুদের হাসি দেখিয়া শশী আরও রাগিয়া গেল। এ জগতে কিছুই যেন কুমুদের কাছে গুরুতর নয়, যখন যা খেয়াল জাগে খেলার ছলেই যেন তা করিয়া ফেলা যায়, জীবনে যেন মানুষের নিয়ম নাই, বাঁচিবার রীতি নাই। মনের রাগ চাপিয়া বিচারকদের রায় দেওয়ার ভঙ্গিতে শশী বলিল, এসব দুৰ্বদ্ধি ছেড়ে দে কুমুদ, যাত্ৰাদলের সং সেজে থাকতে তোকে কে বলেছে? সরস্বতী অপেরায় ঢুকে আর কাজ নেই, ফিরে যা তোর কাকার কাছে। কাকার তোর অত বড় মাইকার কারবার, একটা ভালোরকম কাজ তোকে তিনি দিতে পারবেন না? তখন সমান ঘরের কতো ভালো ভালো মেয়ে পাবি, তোর উপযুক্ত সঙ্গিনী হতে পারবে। খেয়ালের বশে একটা গেঁয়ো মেয়েকে বিয়ে করে কেন জ্বলে মরবি আজীবন?
কুমুদ বলিল, কাকার দুটো গ্রেট ডেন কুকুর আছে জানিস?
শশী অবাক হইয়া বলিল, না।
কাকার বাড়ির গেটের ভেতর ঢুকলে কুকুর দুটো তিনি লেলিয়ে দেবেন।
কথাটা হইতেছিল শশীর ঘরে,–সন্ধ্যার পর। ঘরে সাত টাকা দামের একটা টেবিল ল্যাম্প জ্বলিতেছিল। এত আলোতে পরস্পরের মুখের দিকে চাহিতে তাদের যেন কষ্ট হইতে লাগিল। রাগ শশীর মনে বেশিক্ষণ টেকে না। খানিক চুপ করিয়া থাকিয়া সে বলিল, মতিকে তোর ভালো লাগল কুমুদ বিশ্বাস হতে চায় না।
প্রথমে আমারও হয়নি। সেবার যখন চলে গেলাম, কে জানত ওর জন্যে আবার ফিরে আসতে হবে!
তারপর কুমুদ তালপুকুরের পাড়ে অবোধ গ্রাম্য বালিকার সঙ্গে তার ভালোবাসার জন্ম-ইতিহাস ধীরে ধীরে শশীকে শুনাইয়া দিল। এতটুকু মেয়ে মতি, তার যে এমন একটা মন থাকিতে পারে যাহাতে অতল মেহের সঞ্চার সম্ভব তা কি কুমুদ জানিত? সরল মনের স্নেহ ছাড়া আর সবই যে ফাকি মানুষের জীবনে, মতি কুমুদকে এ শিক্ষা দিয়াছে। সত্য কথা বলিতে কি, এ অপূর্ব অভিজ্ঞতা কুমুদ তো কোনোদিন কল্পনাও করে নাই। শুনিতে শুনিতে শশীর বিস্ময়ের সীমা থাকে না। মতি? ওই একরত্তি নোংরা মেয়েটা গোপনে গোপনে এত ভালোবাসিয়াছে কুমুদকে? শশীর মনে হয় সব কুমুদের বানানো,-দিবাস্বপ্ন, কল্পনা মুখে মুখে গীতগোবিন্দের মতো যে মহাকাব্য কুমুদ রচনা করিয়া চলিয়াছে, মতি কি কখনও তার নায়িকা হইতে পারে?
সেদিন অনেক রাত্রি অবধি শশী ঘুমাইতে পারিল না। কুমুদের সঙ্গে মতির বিবাহ? কেমন করিয়া ইহা ঘটিতে দেওয়া যায়। চিরদিন কুমুদ ছন্নছাড়া যাযাবরের জীবন যাপন করিয়াছে, সাময়িক একটা নীড় প্রেম তার মধ্যে দেখা দিলেও এটা যে স্থায়ী হইবে বিশ্বাস করা কঠিন। তা ছাড়া মতির মূর্খতা এবং গ্রাম্যতা অসহ্য হইয়া উঠিতে কুমুদের বোধ হয় ছমাস সময়ও লাগিবে না। কী উপায় হইবে মতির তখন? কুমুদ কষ্ট দিলে, ত্যাগ করিলে, নিরীহ বোকা মেয়েটার জীবন যে দুঃখে ভরিয়া উঠিবে কে তার দায়িত্ব গ্রহণ করিবে? একদা-প্রিয় বস্তুগুলি জীবন হইতে ছাঁটিয়া ফেলাই যে স্বভাব কুমুদের।
পরদিন কুমুদকে সে এ-বিষয়ে প্রশ্ন করিল। বলিল, মতিকে তোর বেশিদিন ভালো লাগবে কেন কুমুদ?
মতিকে আমার চিরদিন ভালো লাগবে।
কী করে লাগবে তাই ভাবছি।
কুমুদ বলিল, শশী, তুই কি ভাবিস বিয়ের পরেও মতি এমনি থাকবে? ওকে আমি মনের মতো করে গড়ে তুলব না? খনি থেকে তোলা হীরের মতো ওকে আমি গ্রহণ করছি,-নিজে কটিব, ঘষব, মাজব, উজ্জ্বল করে তুলব। ওর মনের কোনো গড়ন নেই, তাই ওকে বিয়ে করতে আমার এত আগ্রহ। ওর মনকে আমি গড়ে নেব। আমার সঙ্গিনী হতে পারে, এমন মেয়ে জগতে নেই ভাই-সঙ্গিনী আমার সৃষ্টি করে নিতে হবে আমাকেই।
শশীর অর্ধেক মন সংসারী, হিসাবী, সতর্ক-এসব বড় বড় কথা শুনিলে তার বিরক্তি জন্মে। মনের মতো গড়িয়া তুলিতে গেলে মানুষ যে মনের মতো হয় না, এটুকু জ্ঞান কি কুমুদের নাই? পরের চেষ্টায় মনের যে বিকাশ তাহা অস্বাভাবিক, অপ্রীতিকর। মতিকে ছাঁচে ঢালিয়া একটা সৃষ্টিছাড়া অদ্ভুত জীবে পরিণত করিবার ধৈর্য কুমুদের থাকিবে কিনা সন্দেহ-থাকিলেও, সেই পরিবর্তিত মতিকে কি তাহার ভালো লাগিবে? কীভাবেই বা মতিকে সে গড়িয়া তুলিবে? লেখাপড়া গানবাজনা ছবি-আকা-শুধু এইসব শিক্ষা তাকে দেওয়া সম্ভব। তার অতিরিক্ত আর কী করিতে পারবে কুমুদ? মতির নিজস্ব সত্তাটুকু পর্যন্ত কুমুদ যদি তাকে দান করে, স্বতন্ত্র সম্পূর্ণ মানুষ হিসাবে কী মূল্য থাকিবে মতির? কুমুদ এত জানে, এটুকু জানে না যে প্রিয়াকে মানুষ গড়িয়া লইতে পারে না। মেয়ের মতো যাকে শিখাইয়া পড়াইয়া মানুষ করা যায় তাকে বসানো চলে না প্রিয়ার আসনে?