জবাব দেব না?
শশী অবাক হইয়া বলিল, জবাব দেয়ার ইচ্ছে আছে নাকি তোর? সব সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে এলি, চিঠির জবাব দিবি কীরকম?
বিন্দু বলিল, দেব না দাদা।–দেব কি না জিজ্ঞেস করলাম।
এও জিজ্ঞেস করতে হয়?
বিন্দু ম্লানভাবে হাসিল, মনটা বড় নরম হয়ে গেছে দাদা—একেবারে সাহস নেই। নিজে নিজে কিছু ঠিক করতে পারি না। নইলে দাখো না, আগে কি পালিয়ে আসতে পারতাম না আমি?
একখানা চিঠি লিখিয়া নন্দ আর সাড়াশব্দ দিল না। শীতের দিনগুলি তাড়াতাড়ি কাটিয়া যাইতে লাগিল। কুসুমের সঙ্গে শশীর কদাচিৎ দেখা হয়। দেখা করিবার জন্য কোনো পক্ষেই যেন তাড়া নাই। তা ছাড়া শশী বড় ব্যস্ত। শীতকালে গ্রামে অসুখবিসুখ কিছু কম থাকে বটে, সে শুধু অন্য সময়ের তুলনায় কিছুদিন আগে বাজিতপুরের হাসপাতালের ডাক্তারের সঙ্গে মুখচেনা ছিল শশীর। তাকে সে বলিয়া আসিয়াছিল, হাসপাতালে কোনো অসাধারণ রোগী আসিলে শশীকে তিনি যেন একটা খবর দেন,— শুধু বই পড়িয়া শেখা যায় না। মাঝে মাঝে শশী বাজিতপুরে যায়। বড় রকমের অপারেশন দেখিবার সুযোগ থাকিলে নিজের রোগীদের কথা ভুলিয়া দু-একদিন সেখানে থাকিয়া আসে।
কুসুম নালিশ করে না। কী যেন হইয়াছে কুসুমের। বোধ হয় ভুলিয়া গিয়াছে নালিশ করিতে। এমন অন্যমনস্কতা মাঝে মাঝে আসে বইকী মানুষের, অভ্যস্ত কাজের যাতে ভুল হইয়া যায়।
ফাল্গুনের গোড়ায় হঠাৎ একদিন কুমুদ আসিয়া হাজির।
কদিন থাকতে দিবি শশী?
যদ্দিন থাকবি,–শশী খুশি হয়, সত্যি থাকবি?
থাকব বলেই এলাম। ভালো লাগলে থাকব।
শশী হাসিল, ভালো লাগার মতো কীই-বা আছে গায়ে? ডোবা জঙ্গল আর মুখ্য মানুষ। ভালো না-লাগলেও থাকিস কুমুদ কিছুদিন। সঙ্গীর অভাবে বড় চিন্তাশীল হয়ে উঠেছি।
কুমুদ বলিল, সঙ্গীর অভাব? বিয়ে কর না?
শশীর হাসি দেখিয়া কুমুদ গম্ভীর হইয়া বলিল, ঠাট্টা করছি না শশী, সত্যি তোর বিয়ে দরকার। শান্ত হিসেবি সাধারণ সংসারী মানুষ তুই। সাধারণ মানুষের জীবন যেমন হয় তোরও তেমনি হওয়া দরকার। অন্যরকম করে বাঁচতে গেলে তুই সুখী হতে পারবি না।
শশী বলিল, তুই তো এরকম ছিলি না কুমুদ, এসব কী পরামর্শ দিচ্ছিস?—আমার ঘরে থাকবি, না, একটা ভিন্ন ঘরের ব্যবস্থা করে দেব তোকে? কুমুদ বলিল, ভিন্ন ঘরে হলে মন্দ নয় না শশী–দু-চার ঘণ্টা একা না থাকতে পারলে কি চলে?
কবিতা লিখিস, অ্যাঁ?
না ঠিক মতো বাঁচতেই জানি না, কবিতা লিখব। লিখতে লজ্জা করে।
কুমুদ লজ্জায় কবিতা লেখে না, এটা আশ্চর্য মনে হয়। জীবনে সে কী চায়, আজও কি কুমুদ তাহা বুঝিতে পারে নাই? জীবনকে লইয়া আজও সে পরীক্ষা করিয়া চলিতেছে? কোন সাগরে মুক্তা আহরণ করিবে তারই আম্বেষণে সাতসাগরে বাসিয়া বেড়াইতেছে? এর চেয়ে বিস্ময়কর কিছু নাই যে শান্ত আর বন্য কোনো মানুষই জীবনের রহস্য ভেদ করিয়া সেই চিরন্তন স্থিতির খোঁজ পায় না, যা অপরিবর্তনীয় হইলেও চলে, যেখানে অভিনবত্ব কাম্য নয় মানুষের। শশীর মতো জীবনকে কুমুদ আজ মন্থর করিতে চায়; আর শশী প্রার্থনা করে কুমুদের অতীত দিনের উত্তপ্ত উচ্ছল জীবনের আবর্ত সুখ যে তাতে বিশেষ হইবে না তা জানে শশী। তবু মনে কেমন করে!
কুমুদ যে কেন গাওদিয়ায় আসিয়াছে শশী ঠিক তাহা বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছিল না। কতদিন থাকিবে তাই বা কে জানে। জিজ্ঞাসা করিলে কুমুদ সেই একই জবাব দেয়। যত দিন থাকতে দিবি। একথার কোনো মানে হয় না। সে যদি ছ মাস একবছরও এখানে থাকিয়া যায়, শশী কি তাহাকে বলিবে যে এবার তুমি বিদেয় হও?
কুমুদের মধ্যে একটা নূতন পরিবর্তন এবার শশীর চোখে ধরা পড়িতেছিল। সেবার তাহার মুখে চোখে কথায় ব্যবহারে যাত্রার দলে অধঃপতনের পরিচয় ছিল স্পষ্ট, এবার সে যেন বহুদিন আগেকার মতো কবি ও ভাবুক হইয়া উঠিয়াছে। কেবল পুরানো দিনের মতো এবার আর তাহার বিদ্রোহী উদ্ধত ভাব নাই। কী যেন সে ভাবে, কী এক রসালো ভাবনা, চোখের দৃষ্টি তাহার হইয়া আসে উৎসুক এবং একান্ত বেমানানভাবে সেইসঙ্গে মুখে ফুটিয়া থাকে গভীর সন্তোষ। তা ছাড়া, গাওদিয়ার মাঠে ঘুরিয়া বেড়ানোর মধ্যে কী রস সে আবিষ্কার করিয়াছে সে-ই জানে—সময় নাই অসময় নাই, কোথায় যেন চলিয়া যায়।
একদিন শশী জিজ্ঞাসা করিল, বিনোদিনী অপেরার কী হল রে কুমুদ?
কুমুদ বলিল, ও দলটা ছেড়ে দিয়েছি। বৈশাখ মাসে সরস্বতী অপেরা বলে আর একটা দলে ঢুকব,–কথাবার্তা সব ঠিক হয়ে আছে। এরা মাইনে অনেক বেশি দেবে। এখনি যোগ দেবার জন্য ঝুলোবুলি করছিল, কিন্তু পার্ট বলে বলে কেমন বিরক্তি জন্মে গেছে ভাই, তাই ভাবলাম কটা মাস একটু বিশ্রাম করে নিই।
কে জানে একথা সত্য কি মিথ্যা। শশীর মনে একটা সন্দেহ উকি দিয়া যায়। সে ভাবে যে হয়তো বিনোদিনী অপেরা হইতে কুমুদকে বিদায় করিয়া দিয়াছে, কোথাও কিছু সুবিধা করিতে না পারিয়া সে আসিয়া আশ্রয় লইয়াছে এখানে-সরস্বতী অপেরার কথাটার বানানো। টাকাকড়ি কিছুই হয়তো কুমুদের নাই।
একদিন শশী বলল, আমায় গোটা পনেরো টাকা দিবি কুমুদ? হাতে নগদ টাকা নেই, একজনকে দিতে হবে।
কুমুদ তাহার সুটকেস খুলিল, একোণ ওকোণ হাতড়াইয়া বলিল, আমার মানিব্যাগ?
কুমুদ ভাবিল, হুঁ, এবার মানিব্যাগ তোমার চুরি যাবে! ছি কুমুদ, আমার সঙ্গেও শেষে তুই ছলনা আরম্ভ করলি!
কিন্তু না ব্যাগ আছে। আমাকাপড় নামাইয়া খুঁজিতেই ব্যাগটা বহির হইয়া পড়িল। কুমুদ বলিল, তোর কাছে রাখতে দেব ভেবে একেবারে ভুলে গিয়েছি ভাই, চুরি গেলেই হয়েছিল আর কি! যা দরকার নিয়ে রেখে দে ব্যাগটা তোর কাছে।