তালবন হইতে শশী সেদিন হালকা মনে বাড়ি ফিরিল।
কুসুমকে বিন্দুরও ভালো লাগিল। কুসুমের কৌতুহল মিটিয়াছিল। বিন্দুর কলিকাতার জীবন সম্বন্ধে সে কোনো কথা তুলিল না। সাধারণ নিয়মে বিন্দু বাপের বাড়ি আসিয়াছে, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নাই, এমনি ভাব দেখাইল কুসুম। বিন্দুর কাছে সে অনেক সময় আসিয়া বসে, নানা কথা বলিয়া বিন্দুকে ভুলাইয়া রাখতে চেষ্টা করে। ওসব পারে সে। সত্যমিথ্যা জড়াইয়া জমজমাট উপভোগ কাহিনী রচনা করিতে কুসুম অদ্বিতীয়া। অপরূপ ভ্রান্তি সৃষ্টি করিবার কৌশল সে জানে চমৎকার। বলে, শহর থেকে শখ করে গাঁয়ে তো এলে ঠাকুরঝি, মরবে ভুগে ম্যালেরিয়ায়। দুবার কাপুনি দিয়ে জ্বর এলে বাপের বাড়িতে পেন্নাম করে কর্তার কাছে ছুটবে তখন।
গোপাল রাগারগি করিল,–শশীর সঙ্গে তার কলহ হইয়া গেল। চেঁচামেচি করিয়া সে বলিতে লাগিল যে এমন কাণ্ড জীবনে সে কখনও দ্যাখে নাই। স্ত্রীকে মানুষ নিজের খুশিমতো অবস্থায় রাখিবে এই তো সংসারের নিয়ম। মারধোর করিলে বরং কথা ছিল। কিছুই তো নন্দ করে নাই। যা সে করিয়াছে বিন্দুর তাতে বরং খুশি হওয়াই উচিত ছিল। যদি নিজের একটা খাপছাড়া খেয়াল মিটাইতে চায়, স্ত্রীর সেটা ভাগ্যই বলিতে হইবে। স্বামীর সে অধিকার থাকিবে বইকী! মদ খায় নন্দ? সংসারে কোন বড়লোকটা নেশা করে না শুনি? তখন বলিলেই হইত, অত অষ্টে বড়লোক জামাই যোগাড় না করিয়া একটা হা-ঘরের হাতে মেয়েকে সঁপিয়া দিত গোপাল,—টের পাইত মজাটা!
কেন ওকে তুই নিয়ে এলি শশী! তোর কর্তালি করা কেন। ছেলেখেলা নাকি এসব, অ্যাঁ? রেখে আয় গে,–আজকেই চলে যা।
তা হয় না বাবা। আপনি সব জানেন না,–জানলে বুঝতেন ওখানে বিন্দু থাকতে পারে না।
এতকাল ছিল কী করে?
সেকথা ভাবিলে শশীও কি কম আশ্চর্য হইয়া যায়!
গোপাল মেয়েকে জিজ্ঞাসা করে, গয়নাগাটি জিনিসপত্র কী করে এলি?
আনিনি বাবা।
কেন, আনোনি কেন?
আমার কী ছিল যে আনব? আনলে চোর বলে জেলে দিত।
শুনিয়া গোপাল রাগিয়া ওঠে।–জেলে দিত! গোপাল দাসের মেয়েকে অত সহজে কেউ জেলে দিতে পারে না। তোরা সবকটা ছেলেমানুষ, কাঁচা বুদ্ধি তোদের। তোরা ঢের কষ্ট পাবি, এই আমি বলে রাখলাম।
গোলমাল করার ফল হইল এই, শশীর সঙ্গে গোপালের আবার কথা বন্ধ হইয়া গেল। ছেলের সঙ্গে এরকম মনান্তর গোপালের বাৎসল্যেরও জগতে মস্বত্তরের সমান, বড় কষ্ট হয়। দিন যায়, কলহ মেটে না। গোপাল উশখুশ করে। ছেলে যেন আকাশের দেবতা হইয়া উঠিয়াছে,-নাগাল পাওয়া কঠিন। শেষে গোপাল নিজেই একদিন মরিয়া হইয়া শশীর ঘরে যায়। শশী মোটা ডাক্তারি বইটা নামাইয়া রাখিলে সেটা সে টানিয়া লয়, পাতা উলটায়, আর ছেলের এত মোটা বই পড়িবার অমানুষি প্রতিভায় সুস্পষ্ট গর্ববোধ করে। বলে, যতক্ষণ বাড়িতে থাকো বই পড়ে সময় কাটাও, শরীর তোমার খারাপ হয়ে যাচ্ছে শশী। এত পড়ো কেন, পরীক্ষা তো নেই? আগে তো এরকম পড়তে না দিনরাত?
ডাক্তারের সর্বদা নতুন বিষয় জানতে হয়।–শশী বলে।
যা তুমি জানো শশী, গাঁয়ে ডাক্তারি করার পক্ষে তাই ঢের।
শহরে গিয়ে যদি বসি কখনও—
কী বিচিত্র চক্র কথোপকথনের বিন্দুর কথা আলোচনা করিতে আসিয়া কী কথা উঠিয়া পড়িল দ্যাখো। শহর? শহরে গিয়া ডাক্তারি করার মতলব আছে নাকি শশীর? তাই এত পড়াশোনা? গোপাল বিবর্ণ হইয়া যায়। এই গ্রামে একদিন কুঁড়েঘরে গোপালের জন্ম হইয়ছিল এইখানে একদিন সে ছিল পরের দুয়ারে অন্নের কাঙাল। আজ সে এখানে দালান দিয়াছে; একবেলায় তার দাওয়ায় পাত পড়ে ত্রিশখানা। চারিদিকে ছড়ানো টাকা, ছড়ানো জমি-জায়গা। ঘরে-বাইরে এখানে তাহার আদর্শ বাঙালি জীবনের বিস্তার। এইখানে মরিতে হইবে তাহাকে। শশী এখানে থাকিবে না, অনুসরণ করবে না তার পদাঙ্ক? গোপল ব্যাকুল হইয়া বলে, ওসব সর্বনেশে কথা মনে এনো না শশী।
শশী বলে, সময় সময় মনে হয় শহরে বসলে পয়সা বেশি হত—
ছাই হত! শহরে ঢের বড় বড় ডাক্তার আছে,-তুমি সেখানে পাত্তাও পাবে না শশী। এখানে মন্দ কী হচ্ছে তোমার? তা ছাড়া, ডাক্তারিতে পয়সা না এলেও তোমার চলবে। জমিজমা দেখবে, সুদ গুনে নেবে। ডাক্তারিতে কিছু হয় ভালো, নাহয় না-ই হবে। গায়ে আর ডাক্তার নেই, অচিকিচ্ছেয় মরে গায়ের লোক, সেটাও তো দেখতে হবে?–বড় তুই স্বার্থপর শশী।
গোপাল পালায়। কী বলিতে কী বলিয়া ফেলিবে, আবার হয়তো পনেরো দিন কথা বন্ধ থাকিবে ছেলের সঙ্গে। খানিক পরে গোপাল আবার শশীর ঘরে ফিরিয়া যায়। বলে, চাবিটা ফেলে গেলাম নাকি রে?
শশী বলে, চাবি? ওই যে আপনার পকেটে চাবি?
চাবির ভারে কর্তার পকেটটা বুলিয়াই আছে বটে। গোপাল অপ্রতিভ হইয়া যায়। পদে পদে জব্দ করে, কী ছেলে। খানিক সে চুপ করিয়া বসিয়া থাকে। তারপর করে কি, হঠাৎ অন্তরঙ্গভাবে জিজ্ঞাসা করে, হ্যা রে শশী, গাঁয়ে তোর মন টিকছে না কেন বল তো, গাঁয়ের ছেলে তুই?
মন টিকবে না কেন?
তবে যে শহরে যাবার কথা বলছিস?
ঠিক করিনি কিছু। কথাটা মনে হয় এই মাত্র।
শশীর শান্ত ভাব দেখিয়া নিজের উত্তেজনায় আর এক দফা অপ্রতিভ হয় গোপাল। ছেলে বড় হইয়া কী কঠিন হইয়া দাঁড়ায় তার সঙ্গে মেশা। সে বন্ধু নয়, খাতক নয়, উপরওয়ালা নয়, কী যে সম্পর্ক দাঁড়ায় বয়স্ক ছেলের সঙ্গে মানুষের, ভগবান জানেন।
একদিন নন্দর একখানা পত্র আসিল বিন্দুর নামে। লিখিয়াছে চিঠি পাওয়ার তিনদিনের মধ্যে ফিরিয়া গেলে এবারের মতো ক্ষমা করিবে। শশী আগুন হইয়া বলিল, ক্ষমাঃ তাকে কে ক্ষমা করে ঠিক নেই, কোন সাহসে ক্ষমার কথা লেখে? তুই যেন ভদ্রতা করে চিঠির জবাব দিতে বসিস না বিন্দু।